ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৫৫): খোররামশাহর মুক্ত করার বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযান
ইরানের সাহসী কমান্ডার আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং ওই বিজয়ে অসামান্য অবদান রাখেন। তবে সাদ্দাম বাহিনীর হাতে এই বীর সেনানির মৃত্যু হয়নি বরং তিনি লেবাননে গিয়ে অনিশ্চিত ভাগ্যলিপির শিকার হয়েছেন।
তিনি ইহুদিবাদী ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে লেবাননের জনগণকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একদল যোদ্ধা নিয়ে ১৯৮২ সালে সিরিয়ায় গমন করেন। তিনি একটি দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে সিরিয়া থেকে লেবাননের প্রবেশ করলে ইহুদিবাদীদের সমর্থনপুষ্ট ফ্যালাঞ্জিস্ট মিলিশিয়াদের হাতে অপহৃত হন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ও তার সহযাত্রীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। তবে গুজব রয়েছে তিনি ইসরাইলি কারাগারে রয়েছেন অথবা তাকে ইহুদিবাদীরা শহীদ করে দিয়েছে।
খোররামশাহর মুক্ত করার বীরোচিত অভিযানে অংশগ্রহণকারী আরেকজন কমান্ডার ছিলেন শহীদ চামরান। তার সম্পর্কে আলোচনা শুরু করার আগে আমাদেরকে ইরানের ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে খানিকটা নজর দিতে হবে। ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী শাহ সরকারের পতনকে পশ্চিমা দাম্ভিক শক্তিগুলো মেনে নিতে পারেনি। তারা ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ইসলামি শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকা ইরানকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুর্দিস্তান অঞ্চলকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার লক্ষ্যে সেখানে বিদ্রোহ উস্কে দেয়।
বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের মাহাবাদ শহরের একটি সেনা ঘাঁটি লুট করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ হাতিয়ে নেয়। এসব অস্ত্র নিয়ে তারা কুর্দিস্তানের কেন্দ্রীয় শহর সানানদাজসহ প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর তারা কুর্দিস্তানের প্রতিবেশী কেরমানশাহ প্রদেশের দিকে অগ্রসর হয় এবং সেখানকার পাভে শহরের দিকে হাত বাড়ায়। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ধারনা করে তারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন শহর দখল করে নিতে পারবে। তারা প্রথমেই পাভে শহর দখল করে সেখান থেকে ইরানের ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে। বিপ্লব বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যখন পাভে শহরে হামলা চালায় তখন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির অল্প কিছু সৈনিক সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা চালালে শহরের অধিবাসীরা আইআরজিসির যোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং প্রাথমিক অবস্থায় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কারণে বিদ্রোহীরা শহরে প্রবেশ করতে পারেনি।
কিন্তু এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা শহরটিকে চারদিক দিয়ে অবরোধ করে ফেলে এবং তাদের অবরোধের গণ্ডি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। ১৯৭৯ সালের ১৩ আগস্ট পাভে শহরে মোতায়েন আইআরজিসির পক্ষ থেকে কেরমানশাহে জরুরি একটি বার্তা পাঠানো হয় যাতে লেখা ছিল: হামলাকারীদের হাতে পাভে শহরের পতন ঘটতে যাচ্ছে, কাজেই দ্রুত সাহায্য পাঠান। বার্তায় বলা হয়, সাহায্যকারী বাহিনী অবিলম্বে না পৌঁছালে দু’একদিনের মধ্যে শহরের পতন ঘটবে। এই বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরানের তৎকালীন উপ প্রধানমন্ত্রী ড. মোস্তফা চামরান, ইরানের সেনাপ্রধান জেনারেল ফাল্লাহি এবং আইআরজিসির অপারেশনাল হেড, আবুশরিফের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল তিনটি হেলিকপ্টারে করে পাভে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। এর দুদিন পর অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের ১৬ আগস্ট বিপ্লব বিরোধী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাভে শহরের একাংশ দখল করে নেয় এবং ৬০ ব্যক্তিকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি আইআরজিসির বহু সদস্য ছিলেন।
এ অবস্থায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন শহীদ মোস্তফা চামরান। তিনি শহরের ঢুকে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তা পরবর্তীতে এভাবে বর্ণনা করেন: আমরা শহরে প্রবেশ করে দেখি আইআরজিসির ঘাঁটি এবং শহরের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অবরোধ করে রেখেছে। তারা লাউড স্পিকারে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করছে: “আপনাদের কোনো ভয় নেই। আপনারা অস্ত্র সমর্পণ করে নিরাপদে থানা থেকে বেরিয়ে যান। কেউ আপনাদের কিছু বলবে না। আমরা শুধু আইআরজিসির সদস্যদের পাশাপাশি ড. চামরানের রক্ত চাই।” এ অবস্থায় এই আশঙ্কা তৈরি হয় যে, কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে পাভে শহরের পতন হবে এবং তারা মারিভান শহর দখল করে যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল পাভেতেও একইভাবে নিরীহ মানুষের ওপর হত্যাকাণ্ড চালাবে।
ড. চামরান আরো বলেন: সংঘর্ষে আইআরজিসির ৬০ জন যোদ্ধার মধ্যে মাত্র ১৬ জন বেঁচে ছিলেন এবং তাদের ভেতর আবার ৬ থেকে ৭ জন আহত থাকার কারণে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তাদের ছিল না। আর প্রায় এক সপ্তাহ অবরুদ্ধ থাকার কারণে খাদ্যের অভাবে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। বেশিরভাগ সহকর্মী নিহত হওয়ায় যারা জীবিত ছিল তারাও বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। শহরের পানির লাইন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কেটে দিয়েছিল। আইআরজিসির ঘাঁটিতে মজুদ খাবারও শেষ হয়ে গিয়েছিল। শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালটি বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছিল এবং সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইআরজিসির ২৫ জওয়ানের সবাইকে তারা হত্যা করেছিল। আর এ সময় সশস্ত্র বিদ্রোহীর সংখ্যা ছিল প্রায় আট হাজার। তারা পাভে শহরের প্রায় সব এলাকার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
শহীদ চামরান পাভে হাসপাতালে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞ এভাবে বর্ণনা করেন: হাসপাতালটির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ২৫ জওয়ানকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের সবাই আহত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে ভর্তি ছিলেন। তাদের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বিদ্রোহীরা তাদের সবাইকে হাসপাতালের পেছনে দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এরপর তাদের কারো কারো মস্তক দেহ থেকে আলাদা করে ফেলা হয় এবং এসব মরদেহের ওপর আরো নানারকম পৈশাচিক অত্যাচার চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। শহীদ চামরান বলেন, এ অবস্থায় আমরা শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। তবে এই শপথ গ্রহণ করি যে, মরতে যদি হয় মরব কিন্তু তার আগে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক হাত দেখে নেব।#
পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/২৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।