সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩ ২০:৫০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার শিকার পাভে শহর নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে পাভে শহর মুক্ত করার ঘটনায় শহীদ মোস্তফা চামরানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

পাভে হচ্ছে ফার্সি ভাষায় একটি কোমল ও নমনীয় নাম। কিন্তু এই শহরটিতে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে সহিংস কিছু গণহত্যা। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের কিছুদিন পরই ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের এই শহরের বিপ্লব বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা শহরের নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণহত্যাসহ সব ধরনের অপরাধযজ্ঞ চালায়।

আমেরিকা ও ইউরোপীয় সরকারগুলোর মদদপুষ্ট এই সন্ত্রাসীরা একবার শহরের সবগুলো প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়ে শহরে মোতায়েন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র জওয়ানদেরকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই হত্যা করেছে। তারা শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য আইআরজিসির জওয়ানদের গলা কেটে হত্যা করার পর তাদের মাথাগুলো শহরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলেয়ে রেখেছে।  এ সময় পাভে শহরে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল অন্তত পাঁচ হাজার। অন্যদিকে শহরের নিরাপত্তা রক্ষায় আইআরজিসির মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য মোতায়েন ছিল।

পাভে শহরের অধিবাসী ও সাবেক স্কুল শিক্ষক আহমাদ হাতামি সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে: পাভে শহরের সাধারণ মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। তাদের যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছিল।  বিদ্রোহীরা শহরে প্রবেশের সবগুলো সড়ক বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য তাদের হাতে নিহত আইআরজিসির সদস্যদের বিচ্ছিন্ন মস্তক শহরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে রাখে। আমি নিজের চোখে তাদের যে অপরাধযজ্ঞটি প্রত্যক্ষ করেছিলাম তা হলো- পাভে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও দর্শনার্থীদের ওপর গণহত্যা। এত বছর পরেও সে দৃশ্যগুলো আজও আমাকে পীড়া দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এতটা নিষ্ঠুর ছিল যে, আহতদের নিয়ে যাওয়ার জন্য যে হেলিকপ্টারটি আনা হয়েছিল তাতেও তারা হামলা চালায়।

সেদিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজিত করে পাভে শহর মুক্ত করতে যেসব যোদ্ধা অকুতোভয় যুদ্ধ করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন ড. মোস্তফা চামরান। আজিজি নামক পাভে শহরের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী এ সম্পর্কে বলেন: ড. চামরান ও তার সহযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে পাভে শহর মুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রেখে যে যুদ্ধ করেছেন তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সেদিন যারা শহরে উপস্থিত ছিল তাদের পক্ষেই সেই যুদ্ধ মূল্যায়ন করা সম্ভব। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে পাভে শহর মুক্ত করার অভিযান সম্পর্কে ড. চামরান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: পাভে শহরের ভয়ঙ্কর রাতে আমার লেবাননের গৃহযুদ্ধের কথা মনে হয় এবং শাহাদাত লাভের মাধ্যমে পার্থিব জগত ত্যাগ করার সম্ভাবনা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। পৃথিবীর সকল বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।

ড. চামরানের হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল ও দয়ালু। তিনি জীবনের কঠিনতম দিনগুলোতে আল্লাহর সঙ্গে সহজতম শব্দগুলো প্রয়োগ করে কথা বলতেন। ড. চামরানের লেখা পড়লে তার কোমল হৃদয় ও দয়ালু মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তার অন্যতম সহযোদ্ধা হোসেইন শাহ হোসেইনি পাভে শহরের ঘটনা বর্ণনা করেন এভাবে: “শহীদ চামরানের প্রস্তাবে আমরা আমাদের জন্য তেহরান থেকে আসা খাদ্য সামগ্রী দুই ভাগে ভাগ করে একভাগ কুমলে নামক বিপ্লব-বিরোধী গোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম। ড. চামরানের এই আচরণের ফলে স্থানীয় সকল কুর্দি জনগণ আইআরজিসিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এবং বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন করে।”

ড. চামরানের রণকৌশল এবং সাহসি সিদ্ধান্তের কারণে বিপ্লব-বিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতা দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে এবং শহরটি পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়। এ সম্পর্কে পাভে শহরের জুমার নামাজের খতিব মামুস্তা মোল্লাকাদের কাদেরি বলেন, যুদ্ধ ও সংঘাত যখন চূড়ান্ত রূপ নেয় তখন শহীদ চামরান ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)কে বার্তা পাঠিয়ে পরিস্থিতিকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে আখ্যায়িত করেন। এর জবাবে ১৯৭৯ সালের ১৮ আগস্ট ইমাম খোমেনী একটি ফিরতি বার্তায় জানান: “আমি সরকার, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছি, যার হাতে যে অস্ত্র আছে তা নিয়ে যদি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাভে শহর অভিমুখে রওনা না হয় তাহলে আমি পাভে শহরের করুন পরিণতির জন্য সবাইকে দায়ী করব।”

ইমামের এই নির্দেশ পাওয়ার পর সবগুলো সশস্ত্র বাহিনী সম্মিলিতভাবে কুর্দিস্তান প্রদেশের পাভে শহরের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আপামর জনসাধারণ। ফলে শুধু পাভে শহর নয় সেইসঙ্গে বানে, সারদাশত, মারিভান ও সাকার শহরও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে মুক্ত হয়। ফলে এর পরের বছর যখন ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালায় তখন বিপ্লব বিরোধী এসব সন্ত্রাসী কুর্দিস্তানের কোনো শহরে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করার সাহস পায়নি। তারা শহরগুলোর বাইরে পাহাড় ও উপত্যকায় আশ্রয় নিয়ে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা চালায়।

পাভে শহরের জুমার নামাজের খতিব কাদেরি ইমাম খোমেনীর বার্তার প্রভাব সম্পর্কে বলেন: ওই বার্তা প্রকাশের পর বিপ্লববিরোধী গোষ্ঠীগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আইআরজিসির জন্য সাহায্য চলে আসে। বহু মানুষ হতাহত হওয়ার বিনিময়ে পাভে শহর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হটিয়ে দেয়া হয়। ড. চামরানের উপস্থিতি এ যুদ্ধে ইরানের জয়লাভে গুরুত্বপূণ ভূমিকা পালন করে। আমরা বিশ্বাস করি প্রথমে আল্লাহর সাহায্য, তারপর ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর চিঠি এবং সবশেষ আপামর জনতার অংশগ্রহণের কারণে পাভে শহর মুক্ত করা সম্ভব হয়।

পাভে শহর মুক্ত করতে গিয়ে ড. চারমান যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন সেটিই ছিল তার জীবনের শেষ সংঘর্ষ। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি ছিলেন মূলত একজন একাডেমিক ব্যক্তিত্ব।  মোস্তফা চামরান ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যাল পর্যন্ত লেখাপড়ায় তিনি সব সময় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করার পর তেহরান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ইলেকট্রোমেকানিক বিষয়ে স্মাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কলারশিপ লাভ করে সেদেশে চলে যান। ড. চামরান ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। #             

 

ট্যাগ