অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-৫)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা আল ফারাবির যুগের মিশর ও পূর্বগ্রিস বা আজকের তুরস্কের কয়েকটি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছিলাম। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্র হচ্ছে বর্তমান সিরিয়ার 'হাররান' শিক্ষাকেন্দ্র যাকিনা আলেকজান্ডারের দখলদারিত্বের সময় থেকে গ্রীক সংস্কৃতি এবং এরপর অরামাইক সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল।
এই শিক্ষাকেন্দ্রে সুরিয়ানি সাহিত্য ও জ্ঞানশিক্ষা অনুবাদের কারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এছাড়া, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং দর্শনের প্রতি খুব মনোযোগী ছিল এই হাররান শিক্ষাকেন্দ্র। "আল-তানবিয়্যাহ এবং আল-আশরাফ" বইতে মাসুদির উল্লেখিত তথ্য অনুসারে, আব্বাসিয় শাসক মুতাওয়াক্কেলের সময় তুরস্কের আন্তাকিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রের জ্ঞানগবেষণার বিষয়বস্তু হাররানে স্থানান্তর করা হয়েছিল। হররান জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আল ফারাবি ওই কেন্দ্রের গুরুত্ব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তবে, তিনি বাগদাদে প্রবেশের আগে নাকি পরে হাররানের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়।
এর আগের পর্বে এবং আজকের পর্বের আলোচনার শুরুতে তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরি অর্থাৎ নবম ও দশম খ্রিস্টাব্দে আল-ফারাবির যুগে মিশর, তুরস্কের আন্তাকিয়া ও বর্তমান সিরিয়ার হাররানের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রের সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি। এ ছাড়া, সেই যুগের আরও দুটি শিক্ষাকেন্দ্রের নাম হচ্ছে 'রোহা' এবং 'নুসাইবিন'। 'রোহা' শিক্ষাকেন্দ্র একসময় প্রাচীন সিরিয় ভূখণ্ড এবং বর্তমান ইরাকের মসুলের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত ছিল। এই কেন্দ্রে দর্শনশাস্ত্র বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের চিন্তা ও গবেষণাকর্মগুলো নিয়ে চর্চা হতো এবং এখানে এই শাস্ত্র বিকাশ লাভ করেছিল। এই শিক্ষাকেন্দ্র থেকে ফারফোরিউসের লেখা 'ইসাগোজি' গ্রন্থ যা ফারাবিও ব্যবহার করেছেন এবং এ গ্রন্থ থেকে তিনি নিজের লেখায় বিভিন্ন বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। গ্রন্থটি সিরিয়াক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। অন্যদিকে, 'নুসাইবিন' সেই শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি যা প্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে গ্রীক জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। ইরানের সাসানিয় শাসনামলে 'নুসাইবিন' শিক্ষাকেন্দ্র ইরান ও রোমের সীমান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে ছিল এবং এটিতে খ্রিষ্টান শিক্ষার প্রাধান্য বজায় ছিল।
'নুসাইবিন' শিক্ষাকেন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটি এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাশাস্ত্র প্রকাশ ও সম্প্রসারণে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিল এবং এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ফারাবি অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন সম্পর্কিত রচনা ও অনুবাদগুলো পড়েছিলেন যা এই শিক্ষাকেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়েছিল। ঠিক একই সময়কালে 'কিন্নাসরিন' শিক্ষাকেন্দ্র নামে আরেকটি স্বল্প পরিচিত বিদ্যাপিঠ ছিল যেটি দ্বিতীয় খলিফা উমর বিন খাত্তাবের সময় সিরিয়ায় বিজিত হয়েছিল। 'কিন্নাসরিন' কেন্দ্রে সিরিয়াক ভাষা ও সাহিত্য জনপ্রিয় ছিল এবং সেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও গ্রীক দর্শন পড়ানো হত। উল্লেখিত এইসব শিক্ষাকেন্দ্রের বেশিরভাগই খ্রিস্টান শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত।
যাইহোক, ফারাবির যুগের আগে এবং তার সমসাময়িক যুগে ইরানিরাও পশ্চিম এমনকি পূর্ব ভূখন্ডে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইরানের মার্ভ, বালখ, নিশাবুর, সোগদ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাদাইন ও জান্দিশাপুরে শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা অবদান রেখেছিল। ইরানিদের স্থাপিত জ্ঞান-গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলো সম্পর্কে এটা বলা যায় যে, এখানে গ্রীক, মিশরীয় ও ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান ছাড়াও ইরানি আবিষ্কার ও গবেষণাকর্ম বিশেষ করে গণিত, চিকিৎসা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, প্রকৌশল, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। ইরানের সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী স্কুল ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্রগুলো তুলনামূলক স্বাধীন হলেও এর পেছনে সবসময় সাসানি শাসকদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। যেমন কখনও কখনও কিছু সাসানি শাসকের নির্দেশে ইরানিদের গবেষণাকর্ম ও রচনাবলীকে উৎসাহিত করা ও জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য ইরানি ও অ-ইরানিদের মধ্যে কথোপকথনের ব্যবস্থা করা হতো। এ লক্ষ্যে গ্রীক, ব্যাবিলনীয়, ভারতীয় ও সিরিয়াক জ্ঞানবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক ইরানিদের জন্য অনুবাদ করা হতো। সেসময় ইরানের এইসব স্কুল বা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর সাথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক অ-ইরানি পণ্ডিত ও ছাত্রদের অব্যাহত যোগাযোগ ছিল। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইরানি শাসক খসরু আনুশিরভানের দরবারে পালিয়ে আসা সাত গ্রীক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর আশ্রয় নেয়ার বিখ্যাত ঘটনা থেকে তৎকালীন সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইরানের খ্যাতনামা জ্ঞান-গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে খুজিস্তানের জান্দিশাপুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাসানি রাজবংশের শাসক প্রথম শাপুর এটি প্রতিষ্ঠিত করেন। এই বিদ্যালয় বা শিক্ষাকেন্দ্রটি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন চিকিৎসা, স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা এবং কিছুটা দর্শনশাস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। যদিও বাগদাদের বিখ্যাত বাইতুল হিকমা শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্র ছিল আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে কিন্তু যেহেতু এটি ইরানের জান্দিশাপুর এবং এর আশেপাশে অন্যান্য অনেক শিক্ষাকেন্দ্রের উত্তরাধিকার হিসাবে বিবেচিত হতো সে কারণে এতে ইরানি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়।
অন্য অঞ্চলের শিক্ষাকেন্দ্রের জ্ঞান বাগদাদের বাইতুল হিকমা শিক্ষাকেন্দ্রে স্থানান্তর কোরে, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বড় বড় শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের বাগদাদ শহরে বসবাসের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে, বাইতুল হিকমায় একাধিক ভাষায় শিক্ষাদান ও শিক্ষাদানের পরিধি আরো বাড়িয়ে এবং বিশেষ করে আরবি ভাষার উপর বিশেষ জোর দেয়ার সাথে সাথে, এই কেন্দ্রটি দ্রুত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং এটি তৎকালীন সময়ে বিশ্বের অন্যতম বড় শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়।
বাগদাদে দারুল হিকমা প্রতিষ্ঠার পর স্বাভাবিকভাবে বাগদাদ ও এর পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অঞ্চল বা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বলা যায় মুসলিম শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ অনুবাদের ব্যাপক জোয়ার শুরু হয়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদের খলিফা মনসুর আব্বাসির সময় থেকে অন্যান্য জাতি যেমন গ্রীক, রোমান, ইরানি এবং সিরিয়ান গবেষণাকর্ম ও মূল্যবান গ্রন্থগুলো মুসলমানদের মধ্যে আগমন ঘটে। অন্যান্য জাতির গ্রন্থ ও গবেষণাকর্মগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ হওয়ায় আব্বাসীয় খেলাফত আমলে নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।