অক্টোবর ২৪, ২০২৩ ১৭:৪০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পাভে শহর মুক্ত করার ঘটনায় শহীদ মোস্তফা চামরানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা এই সংগ্রামি নেতা ও সাহসী যোদ্ধার ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে খানিকটা কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ড. চামরান শুধু একজন যোদ্ধা ও একাডেমিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান এবং নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীর দিক দিয়ে তিনি নিজেকে অনেক উন্নত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামে জিহাদ ও ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষা করার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শহীদ মুর্তজা মোতাহারি এ সম্পর্কে লিখেছেন: ইসলাম এমন কোনো ধর্ম নয় যে বলবে, কেউ যদি তোমার ডান গালে চড় মারে তাহলে তুমি বাম গালটিও তার সামনে এগিয়ে দাও। অথবা একথাও বলেনি যে, আল্লাহর কাজ আল্লাহর জন্য এবং রাজার কাজ রাজার জন্য ফেলে রাখো। এছাড়া, সমাজকে পরিশুদ্ধ করার জন্যও এই ধর্মের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। সমাজ পরিশুদ্ধ করার এই গুরুদায়িত্ব পালনকারী ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বদের অন্যতম ছিলেন ড. মোস্তফা চামরান।  তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পর নাসার একটি গবেষণাগারে কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করা সত্ত্বেও নিজ দেশের সমাজ পুনর্গঠনে কাজ করার জন্য ইরানে ফিরে এসেছিলেন।

মোস্তফা চামরান পরিবারিকভাবে ইসলামি মূল্যবোধের চেতনা নিয়ে বড় হয়েছিলেন। শৈশবকাল থেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও সব সময় চেষ্টা করতেন অভাবী ও দুঃস্থ মানুষের সেবা করতে। তিনি নিজের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমৃত্যু লালন করেছেন। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করার সময় তার স্থাবর বা অস্থাবর কোনো সম্পদ ছিল না। তার শৈশবকালের অনেক সত্য ঘটনা বই-পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। একবার তার পিতা তাকে রুটি কেনার জন্য কিছু টাকা দেন। পথিমধ্যে একজন দুঃস্থ ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে তিনি রুটি কেনার টাকা তাকে দান করে খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসেন। কেন রুটি কিনে আনোনি- পিতার এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তফা বলেন: টাকাটা একজন ভিখারিকে দান করে এসেছি।

এভাবে চামরান পরোপকার করার পাশাপাশি লেখাপড়ায় গভীর মনোনিবেশ করেন এবং সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সম্পর্কে চামরান বলেন: আমি চেষ্টা করেছি জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেকে এতটা উন্নত করতে যাতে কেউ আমাকে এই জ্ঞানের কথা বলে বিভ্রান্ত করতে না পারে। যারা একটু শিক্ষিত হয়েই অন্যদের সামনে নিজেদের জাহির করে তারা আমার সামনে নতজানু হয়ে চলতে বাধ্য হয়। হে আল্লাহ! আমাকে এমন তৌফিক দাও আমি যেন ওদের মতো অহংকারী না হয়ে বিনয়ী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।

মোস্তফা চামরান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করার পর তেহরান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৭ সালে ইলেকট্রোমেকানিক বিষয়ে স্মাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ইরানের সরকারি স্কলারশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ড. চামরান ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।    

ডক্টরেট পর্যায়ে তার গবেষণার বিষয় ছিল ইলেকট্রনিক্স ও প্লাজমা ফিজিক্স।  সেই যুগে সারাবিশ্বে তার সমান একাডেমিক সার্টিফিকেটধারী মানুষ ১০ জনও ছিল না।  ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করার পর মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা তাৎক্ষণিকভাবে মোস্তফা চামরানের কাছে নিয়োগপত্র পাঠায় এবং তিনি নাসার একটি গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। ড. চামরান ইরানে হোক বা আমেরিকায় হোক, ছাত্রাবস্থায় কখনই ইরানের তৎকালীন রেজা শাহ পাহলাভির নেতৃত্বাধীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেননি। তিনি যখন আমেরিকায় পড়াশুনা করছেন তখন শাহ সরকার বিষয়টি টের পেয়ে তার সরকারি স্কলারশিপ বাতিল করে দেয়। এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনীকে এই নির্দেশ দেয়া হয় যে, মোস্তফা চামরান দেশে ফেরামাত্র যেন তাকে গ্রেফতার করা হয়।

ড. মোস্তফা চামরানের জীবনকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করলে আমেরিকায় তার লেখাপড়া দ্বিতীয় ভাগে পড়বে। তার জীবনের তৃতীয় ভাগে রয়েছে ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমেরিকা থেকে মিশর ও লেবাননে গমন। জীবনের এই স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তটি থেকে মোস্তফা চামরানের অন্তরের বিশালতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ১৯৬৩ সালে এমন একটি সময়ে গেরিলা যুদ্ধ শেখার জন্য আমেরিকা থেকে মিশরে যান যখন তার সমান শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারা যেকোনো মানুষের জন্য একটি বিরল সৌভাগ্যের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতো। তিনি দুই বছর প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ১৯৬৫ সালে সরাসরি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লেবাননে গমন করেন।

তিনি যখন মিশরে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন তখন দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের। মিশরের এই স্বাধীনচেতা প্রেসিডেন্ট ইহুদিবাদীদের কবল থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড মুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু তার অকালমৃত্যুর পর যারা মিশরের ক্ষমতায় এসেছেন এবং এখন পর্যন্ত আছেন তারা ইহুদিবাদী ইসরাইলের পদলেহনেই বেশি সময় কাটিয়েছেন। যাই হোক, প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষ হলে মোস্তফা চামরান লেবাননের তৎকালীন শিয়া নেতা ইমাম মুসা সাদরের আমন্ত্রণে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে লেবাননে যান এবং সেখানকার সশস্ত্র সংগঠন ‘আমোল’-এর অন্তর্ভুক্ত হন। সে সময় লেবাননের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী শিয়া হওয়া সত্ত্বেও তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল অন্য সবার চেয়ে খারাপ। মোস্তফা চামরান ইসরাইল বিরোধী যুদ্ধের পাশাপাশি লেবাননের মুসলমানদের মধ্যকার মাজহাবগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং এর ফলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শিয়া মুসলমানদের অবস্থান শক্তিশালী হয়।

ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ দেশটির বিভিন্ন শহর চষে বেড়িয়েছেন মোস্তফা চামরান। লেবাননের ভূখণ্ড থেকে ইহুদিবাদী সেনাদের বহিষ্কার করার সে লড়াইয়ে চামরানের অবদান অনস্বীকার্য। লেবাননের সংগ্রামী নেতারা এখনও শ্রদ্ধাভরে তার নাম স্মরণ করেন। আমরা যদি লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে সে আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা হিসেবে ড. মোস্তফা চামরানের নাম উঠে আসবে। 

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরে আমরা ড. চামরানের জীবনের আরো কিছু দিক সম্পর্কে কথা বলব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।