অক্টোবর ২৪, ২০২৩ ১৮:১৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের সংগ্রামি নেতা ও সাহসী যোদ্ধা শহীদ মোস্তফা চামরানের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে খানিকটা কথা বলেছি। আজ আমরা ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের প্রাথমিক দিনগুলোর অবস্থা এবং সেইসঙ্গে ওই সময়ের যুদ্ধে ড. চামরানের অবদান নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া আট বছরের যুদ্ধের প্রথম বছর ছিল ইরানের জন্য সবচেয়ে কঠিন বছর। তবে ওই বছর যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানি সৈনিকেরা আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। ১৯৭৯ সালে মার্কিনীদের তাবেদার শাহ সরকারকে হটিয়ে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার পর ইরানে একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর জন্য দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র হতে তাকে। বিদেশে এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিল আমেরিকা। এসব ষড়যন্ত্রের কারণে ইরানের ইসলামি সরকারের পক্ষে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার কাজটি করাই ছিল কষ্টসাধ্য। ঠিক সেরকম একটি পরিস্থিতিতে ইরানের ওপর আগ্রাসন চালায় ইরাক।  কিন্তু ওই আগ্রাসন এককভাবে মোকাবিলা করা ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ইরানের আপামর জনসাধারণ ইরাকি বাহিনী আগ্রাসন প্রতহত করার কাজে এগিয়ে আসে।

ইরাকের মতো একটি সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হলে গেরিলা যুদ্ধ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়কে উপযুক্ত মনে করেননি অনেক সেনা কমান্ডার। কারণ, নবগঠিত ইসলামি সরকার তখনও সেনাবাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’সহ অন্যান্য বাহিনীকে সমন্বয় করতে পারেনি।  শুধু যে সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল না তাই নয়, বরং ইরানের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও ইরাকি আগ্রাসন প্রতিহত করার পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ ছিল।  শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এই মতবিরোধ ছিল ইরানের একটি বড় দুর্বলতা, কারণ এর ফলে ইরানের সবগুলো বাহিনীকে একসঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া বা তাৎক্ষণিকভাবে যেখানে যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োজন সেখানে তা পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না।  দেশের শীর্ষস্থানীয় নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এই মতবিরোধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম প্রেসিডেন্ট বনি সদর। তিনি ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের সময় বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)’র সঙ্গে থাকলেও পরবর্তীতে আমেরিকা ও বিপ্লব বিরোধীদের ষড়যন্ত্রে পা রাখেন এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলে যান।

এরকম একটি স্পর্শকাতর সময়ে কিছু বিপ্লবী নেতা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি কুর্দিস্তান অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করার জন্য গণবাহিনী সুসংগঠিত করার কাজে সৃজনশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন। একরম একজন বিপ্লবী নেতা ছিলেন ড. মোস্তফা চামরান। তিনি যুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় আহওয়াজ শহরে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। সেখানে তিনি কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে দখলদার  সেনাদের কবল থেকে কিছু শহর পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি ইরাকি বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে তাদেরকে ইরাকের মাটিতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন।

গত দুই আসরে আমরা ড. চামরান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছি, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষ করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায় কাজ করার দুর্লভ সুযোগ পরিত্যাগ করে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিতে মিশর গমন করেন এবং সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে লেবাননে সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেন।

ড. চামরানকে লেবাননের ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তিনি ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে যখন লেবাননে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করছিলেন তখন ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে। ফলে তিনি নিজ দেশে ফিরে ইসলামের সেবা করার সিদ্ধান্ত নেন। ইরানে ফিরে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সরকারের সামনে থাকা নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ড. চামরান ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে কাজ করার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।  ড. মোস্তফা চামরান কখনও ক্ষমতা, অর্থ কিংবা সুনামের পেছনে ছোটেননি। তাকে বরং ইসলামি শাসনব্যবস্থা যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে তিনি তা সুচারুভাবে পালন করার চেষ্টা করেছেন।

ড. মোস্তফা চামরানের গেরিলা যুদ্ধের কথা যখন হলোই তখন ওই যুদ্ধে তার সঙ্গে অংশগ্রহণকারী আরেকজন যোদ্ধার নাম না বললেই নয়। আর সেই যোদ্ধা আর কেউ নন বরং তিনি হলেন আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী। সে সময়ে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদে ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর প্রতিনিধি, তেহরান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং তেহরানের জুমার নামাজের খতিব।  

সে সময় গেরিলা যুদ্ধের কমান্ডারদের দায়িত্ব ছিল উৎসাহী তরুণ ও যুবকদের সংগঠিত করে তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে চোরাগুপ্ত হামলা চালিয়ে ইরাকি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করা। একটি সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ সম্ভব নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শত্রুসেনাকে ঘায়েল করার জন্য গেরিলা যুদ্ধই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।

ড. মোহাম্মাদ চামরান আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের কার্যকারিতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এ কারণে তিনি মিশর, লেবানন ও সিরিয়ায় অজির্ত গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ইরানে কাজে লাগান।

সে সময় আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশের বৃহত্তম শহর আহওয়াজ অবরোধ করেছিল। আহওয়াজের পতন হলে ইরাক-ইরান যুদ্ধের ভাগ্য অন্যরকম হতে পারত।  শহরটি দখলে নিতে পারলে ইরাকি শাসক সাদ্দাম ভাবত, তার পক্ষে এরপর গোটা খুজিস্তান প্রদেশ এবং তারও পরে রাজধানী তেহরান দখল করা সম্ভব হবে। এ সম্পর্কে আয়াতুল্লাহিল উজমা খেমেনয়ী বলেন, ইরাকের আড়াই ডিভিশন সেনার বিপরীতে আমাদের ছিল মাত্র এক ব্রিগেড যোদ্ধা। ইরাকি বাহিনী আহওয়াজ শহরের ২০ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় ইরানি যোদ্ধাদের খবর শোনার পর তারা আর সামনে আগায়নি।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ইরাকি বাহিনী ইরানের মাত্র একটি ব্রিগেডের ভয়ে সামনে অগ্রসর হয়নি। আমাদের যোদ্ধারা ৫০ থেকে ৬০ জনের টিম গঠন করত। তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শত্রুসেনাদের ঘাঁটিতে পৌঁছে যেত এবং সেখানে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসত।  আহওয়াজ ছাড়াও খুজিস্তান প্রদেশের অপর দুই শহর সুসাংগার ও হুয়াইজা শহরেও ইরানি যোদ্ধারা তৈরি করেছিলেন বিজয়ের বীরত্বগাঁথা। সুসাংগার শহর ইরাকিদের কবল থেকে মুক্ত করতে ড. চামরান কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে ইরাকি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হুয়াইজা শহরের পতন ঠেকাতে অসামান্য অবদান রাখেন অপর কমান্ডার শহীদ হোসেইন  আলামুল হুদা।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।