অক্টোবর ৩১, ২০২৩ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের সংগ্রামি নেতা ও সাহসী যোদ্ধা শহীদ মোস্তফা চামরানের ঘটনাবহুল জীবন এবং পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে এই মহান যোদ্ধার অবদান ও তাঁর শাহাদাত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই গেরিলা কমান্ডারসহ ইরানি যোদ্ধা ও কমান্ডারদের সাহসিকতা ও বীরত্ব নিয়ে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ড. মোস্তফা চামরান শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সংগ্রামী জীবনে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা এবং জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে নিজের প্রধান কর্তব্য মনে করতেন। তিনি ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর লেবাননে ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে দেশে ফিরে আসেন। ইরানে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সরকার ব্যবস্থার হাত শক্তিশালী করার কাজে তিনি নিজের সমস্ত প্রতিভা ও অভিজ্ঞতা ঢেলে দেন। এরমধ্যে ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালালে চামরান একথা উপলব্ধি করেন যে, একটি আগ্রাসী বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য ইরানের সেনাবাহিনীর মধ্যে যে সংহতি থাকা দরকার তা নেই। তাই তিনি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশের আহওয়াজ শহরকে কেন্দ্র করে একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর পাশাপাশি চামরানের নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনীর প্রতিরোধের কারণে ইরাকি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ আহওয়াজ শহরের পতন হয়নি। সেইসঙ্গে খুজিস্তান প্রদেশের কয়েকটি শহর ও গ্রাম থেকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। ইরানে সাদ্দাম বাহিনীর আগ্রাসনের ৯ মাসের মাথায় খুজিস্তান প্রদেশের দেহলাভিয়ে এলাকায় ইরাকি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে শহীদ হন মোস্তফা চামরান। এই সংগ্রামী গেরিলা কমান্ডার ছিলেন সাহসিকতা এবং শৌর্য ও বীর্যের মূর্ত প্রতীক।  মানুষ যে স্থানে নিজের সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের সর্বোচ্চ সুযোগ পায় তা হচ্ছে যুদ্ধের ময়দান। যুদ্ধ হচ্ছে এমন একটি ময়দান যেখান থেকে কেবল সাহসি ও বীর যোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসতে পারে। পবিত্র কুরআনেও ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলিম যোদ্ধা ও মুজাহিদদের যে গুণের প্রশংসা করা হয়েছে তা হচ্ছে তাদের বীরত্ব এবং শৌর্য-বীর্য।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ওহুদের ময়দান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় মক্কার কাফিরদের এই মর্মে অনুশোচনা হয় যে, আমরা বিজয় অর্জন করার পরিবর্তে অনর্থকই ফিরে এলাম। সবাই মিলে একটা কঠিন আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত মুসলিমকে খতম করে দেয়াই উচিত ছিল। আর এই কল্পনা তাদের মনে এমনই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল যে, পুনরায় মদীনায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করতে লাগল।  এ ব্যাপারটি ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতে পারলেন। কাজেই তিনি মদীনা থেকে ৮ মাইল দূরে ‘হামরাউল আসাদ’ পর্যন্ত কাফিরদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, এই পশ্চাদ্ধাবনে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন যারা গত কালকের ওহুদ যুদ্ধে কঠিনভাবে আহত হয়ে পড়েছিলেন এবং অন্যের সাহায্যে চলাফেরা করছিলেন। এই ঘটনার পর পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১৭২ ও ১৭৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়।

আয়াতে সেই সব বীর যোদ্ধাদের প্রশংসা করা হয় যারা আহত অবস্থায় শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন। এরশাদ হচ্ছে: “যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকাজ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।” “এদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, 'আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক।”

ইরাকের বিরুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের পরতে পরতে ইরানি যোদ্ধারা সাহসিকতার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।  ইরাকি বাহিনীর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী দেখে ইরানি যোদ্ধারা ভীত হননি।  তারা আগ্রাসী বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতেন এবং অসংখ্য বিপদ ও প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শত্রুসেনাদের ধরাশায়ী করতেন।

ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রশংসা করে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেন: আমরা যুদ্ধের ময়দানে দেখেছি যে, আমাদের বীর যোদ্ধারা কুচক্রি ইরাকি বাহিনীর উপর বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তারা কোনো কিছুকে পরোয়া করে না। আর ইরানি যোদ্ধাদের দেখলেই ইরাকি বাহিনী সবকিছু ফেলে পালিয়ে যায়।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের অন্যতম কমান্ডার হাসান বাকেরির সাহসিকতা সম্পর্কে কথিত আছে: তিনি যেকোনো অভিযানের আগের রাতে শত্রু সেনাদের শিবিরে চলে যেতেন। সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর সবকিছু ঠিক থাকলে নিজ সেনাদের অভিযান শুরু করার নির্দেশ দিতেন।

ইরানের আরেক কমান্ডার শহীদ মেহদি বাকেরির সাহসিকতা সম্পর্কেও অনেক ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। ফাতহুল মোবিন অভিযান সম্পর্কে মেহদি বাকেরির একজন সহযোদ্ধা বলেন: অভিযানটি ছিল এমন যে, আমাদেরকে সন্ধ্যা রাতে রওনা দিয়ে সাত ঘণ্টা হাঁটার পর শত্রুসেনাদের ওপর হামলা করতে হবে। কিন্তু প্রায় ছয় ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলি। এ অবস্থায় ভীষণ রকম মুষড়ে পড়ি আমরা। সবাইকে অপেক্ষমান রেখে কয়েকজন সামনে এগিয়ে যাই সঠিক পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য। হঠাৎ রাতের অন্ধকারে মনে হলো কেউ সামনে থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা ভাবি নিশ্চয় কোনো শত্রুসেনা হবে। নিজেদেরকে আড়াল করে জিজ্ঞাসা করি: কে ওখানে? উত্তর আসে: “আমি বাকেরি। দ্রুত ফিরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে এসো।” আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, আমাদের কমান্ডার আমাদের আগে শত্রুসেনাদের পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসেছে। তিনি আমাদের বলেন: “ভয় পেয়ো না। শত্রুসেনারা ঘুমিয়ে আছে।” ইরানি সেনা কমান্ডাররা এভাবেই সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের আরেক কমান্ডার ছিলেন শহীদ হাজি হোসেইন খাররাজি। ইমাম হোসেইন ব্রিগেডের এই কমান্ডার শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন। তার হাত ছিল একটি। এই এক হাতে অস্ত্র নিয়ে তিনি ফাও দ্বীপ দখলের ওয়াল-ফাজর-৮ অভিযানে অংশ নিয়ে শত্রুসেনাদের নাস্তানাবুদ করেন। ফাও দ্বীপ দখলের অভিযানে শহীদ হোসেইন খাররাজির অকুতোভয় লড়াইয়ের কাহিনী আজও ইরানি জনগণ স্মরণ করে কৃতজ্ঞচিত্তে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরে আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র ইমাম হোসেইন ব্রিগেডের কমান্ডার শহীদ হোসেইন খাররাজি সম্পর্কে আরও আলোচনা করব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/ বাবুল আখতার/ ৩১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।