নভেম্বর ০১, ২০২৩ ১৭:২১ Asia/Dhaka

সিজোফ্রেনিয়া ব্রেনের ভয়ানক একটি জটিল রোগ। তবে সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে শতকরা ৫০ ভাগ রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে পারে। চিকিৎসার জন্য অবশ্যই যেতে হবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। লজ্জা শরম কিংবা লোকভয় ত্যাগ করে যথাযথভাবে এ রোগের চিকিৎসা করা হলে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেন।

সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে অতি সাধারণভাবে যেটি বলা যায় সেটি হচ্ছে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরকে প্রতিদিনই দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়। এমনকি মানসিক রোগের জগতেও সিজোফ্রেনিয়া এখনো একটি ট্যাবু হয়ে আছে এবং এনিয়ে খুব বেশি একটা কথা বলা হয় না। সিজোফ্রেনিয়া তীব্র একটি মানসিক রোগ যার ফলে রোগী বাস্তবতার বোধ বা উপলব্ধি হারিয়ে ফেলেন। তো চলুন মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন সুস্থ আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি ৪ জনের ভিতর একজন মানুষ কোনো একটি মানসিক রোগের শিকার হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ মিলিয়ে একশ কোটির বেশি মানুষ বর্তমানে মানসিক রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশ এবং ভারতে বর্তমানে মানসিক রোগের সংখ্যা অনেক বেশি।

আমরা কয়েক পর্বে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ নিয়ে কথা বলব। তবে শুরুতে কয়েক পর্বে সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে কথা বলব। কারণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রিয় শ্রোতাবন্ধু দেবাশিষ গোপ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। তার অনুরোধে আমরা বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা করব। আবারও বলছি এই জন্যে কয়েক বছর আগেও বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। তো চলুন সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে আলোচনায় যাওয়া যাক। আর আমাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অতিথি হিসেবে  আছেন- বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান- অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম।

অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম: আপনাকে ধন্যাবাদ।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম, আলোচনার শুরুতেই জানতে চাইব সিজোফ্রেনিয়া রোগটি আসলে কি?

অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম: আপনাকে ধন্যবাদ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আপনি আজ আলোচনা করতে চাইছেন। দেখুন আমাদের সব মেডিসিনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগ আছে- যেমন ধরুন, কিডনি, হার্ট, ফুসফুস ইত্যাদি। একইভাবে আমাদের নিউরো সাইন্স আছে। আছে ব্রেনের রোগ। ব্রেনের রোগ আবার দু ধরনের। কিছু আছে সরাসরি নিউরোলজি। আর কিছু আছে যেগুলো নিউরোলোজির সঙ্গে সম্পৃক্তি কিন্তু সেসব রোগকে আমরা মানসিক রোগেরই প্রকাশ বলে থাকি।

রেডিও তেহরান: তাহলে ব্রেনের দুই ধরনের রোগের মধ্যে মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়াও একটি ব্রেনের রোগ তাইতো..

সিজোফ্রেনিয়া মানে পাগল নয়

অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম: সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক রোগ। সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে আমি এ বছর একটি বই লিখেছি। বইটির নামই হচ্ছে- সিজোফ্রেনিয়া একটি চিকিৎসাযোগ্য ব্রেনের রোগ। মানুষ কিন্তু- মানসিক রোগকে বুঝতে পারে না। আপনি যখন প্রশ্ন করলেন সিজোফ্রেনিয়া কি?  আর আমি সেজন্য নামটাই রেখেছি চিকিৎসাযোগ্য ব্রেনের রোগ। অনেকে মনে করেন সিজোফ্রেনিয়া হয়তো চিকিৎসায় ভালো হয় না। কিন্তু সেই ধারনাটা ঠিক নয়। এটি চিকিৎসাযোগ্য। একইসাথে এটি যে ব্রেনের রোগ সেটিও এই নাম থেকে বোঝা যায়। কি কারণে ব্রেনের রোগ সে সম্পর্কে এবং ব্রেনের ম্যাকানিজম নিয়ে এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সংক্ষেপে সিজোফ্রেনিয়া কি- সিজোফ্রেনিয়ো হচ্ছে খণ্ডিত মন। ইংরেজিতে রোগটিকে "স্কিটসোফ্রিনিয়া" (Schizophrenia) নামে ডাকা হয়। ইংরেজি "স্কিটসোফ্রিনিয়া" শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দমূল skhizein (σχίζειν, "to split" বা “দুভাগ করা”) এবং phrēn, phren- (φρήν, φρεν-; "mind" বা “মন”) থেকে৷ এমন নামকরণ সত্ত্বেও স্কিটসোফ্রিনিয়া বলতে আদপে “দ্বিখন্ডিত মন” বুঝায় না।

এই রোগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না৷[১৩] এর লক্ষণগুলো হলো উদ্ভট চিন্তা, বিভ্রান্তিকর বা অলীক কিছু দেখা, অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা এবং অন্যরা যা শুনতে পায় না এমন কিছু শোনা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক বা কর্মক্ষেত্রে সচারচর অক্ষমতাজনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন৷ 

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, খন্ডিত মন বললেন- বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলুন..

অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম: দেখুন খণ্ডিত মন বলতে- যেসময় নিউরোলজি আজকের মতো ডেভেলাপ করেনি তখন সাধারণভাবে যারা এইসব রোগ নিয়ে গবেষণা করতেন বা চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন তারা এই ধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে যে জিনিষটি লক্ষ্য করতেন সেটি হচ্ছে- রোগীরা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাবার্তা বলে। কোনোরকমের যোগসূত্র ছাড়াই এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে চলে যায়। অনেকটা এলোমেলো কিংবা আবোল-তাবোল কথাবার্তা বলে থাকে। এর ভিত্তিতে তখনকার চিকিৎসক বা গবেষকরা মনে করলেন বোধহয় রোগীর মনোজগত খণ্ডিত হয়ে গেছে। কোনো জায়গায় ফেটে গেছে কিংবা আলাদা হয়ে গেছে। আর সেজন্যে রোগীরা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। আর সে কারণে অনেক আগ থেকেই সিজোফ্রেনিয়া নামটা দেয়া হয়েছিল আর এখনও সেই নামটাই বহাল আছে। যদিও কেউ কেউ নাম বদলের চেষ্টা করেছে কিন্তু সেটি হয় নি। নাম বদলের চেষ্টার কারণ হচ্ছে- সিজোফ্রেনিয়া নামটি একটি লোক লজ্জার কারণ হয়ে গেছে। রোগী এবং রোগীর আত্মীয় এমনকি আমরা যারা চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত তাদের কাছেও এটি লজ্জার কারণ বলে মনে হয়। 

আমাদের সব রোগী কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো। আপনার আমার মতো স্বাভাবিক আচরণ চিন্তায় এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারপরও অনেক ধরনের মনোজগতের সমস্যা, আবেগজনিত সমস্যা এবং আচরণগত সমস্যা থাকতে পারে। এ ধরণের সমস্যা শতকরা ৯৯ ভাগের। আর মাত্র ১ ভাগ থাকে যেটি সিজোফ্রেনিয়া ধরনের। একে সাইকোসিস বলা হয়। আর সাইকোসিস রোগটাকেই মনে করা হয় মানসিক রোগের একটি জটিল স্তর। আর মানসিক রোগ মানেই হচ্ছে সাইকোসিস কিংবা সিজোফ্রেনিয়া বলে অনেক মনে করেন। তাদেরকে পাগল বলা হয় কিংবা বদ্ধ উন্মাদ বলা হয়।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তাজুল ইসলাম- তারমানে আমরা যারা জানি না সিজোফ্রেনিয়া রোগটা আসলে কি তারা সিজোফ্রেনিয়ার আক্রান্ত মানুষ যিনি -আবোল তাবোল কথা বলছেন তাকে দেখলে পাগল বলি, মাথা খারাপ বলি- এরকম কি?

সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসাযোগ্য রোগ

অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম: জ্বি এটাই। শুধু সিজোফ্রেনিয়া না মানসিক রোগী আমরা যাদেরকে বলি বা মানসিক রোগী হিসেবে যারা আমাদের কাছে আসেন তাদের অনেকে সাইকোসিস বা সিজোফ্রেনিয়ার ধারে কাছেও নেই; সাধারণ মানুষ, নর্মাল মানুষ- উদ্বেগ, উৎকণ্ঠ, বিষণ্ণতা, আবেগ, সম্পর্কজনিত জটিলতা বা মানসিক চাপের কারণে  কিছু মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে এলেই তাকে সাইকোসিস, সিজোফ্রেনিয়া, পাগল, উন্মাদ এ ধরনের কথা বলতে দেখা যায় আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। এমন কথাও শোনা যায়- তোমার আত্মীয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোমরা সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কেনো যাচ্ছ? ফলে মনো চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি খুব বড় ধরনের সামাজিক বাঁধা। মানসিক রোগী মানেই সাইকোসিস নয়; এটি বোঝাতেই আমাদের চিকিৎসকদের অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়। তবে আমরা এখন কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি সেই সংকট।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, অনেক সময় দেখা যায় মানসিক রোগী কিন্তু তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিউরোলোজিস্টের কাছে- এটা কেন?

অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম: একটু আগেও সে কথা বলছিলাম। সামাজিক সংকট আছে। মানসিক রোগ অথচ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিউরোলজিস্টের কাছে। মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে আসতেই চায় না। মানুষ এই ভয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে যেতে চায় না-যে লোকে তাকে পাগল বলবে। নিউরোলোজিস্টের কাছে নিয়ে গেলে আর সেই ভয় নেই।  মানে হচ্ছে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে গেলেই এই তকমা লেগে যায় তারা বোধহয় পাগল রোগী। এই ধারনা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

আমরা সবাই চেষ্টা করছি আপনাদের মিডিয়ার মাধ্যমে এই লোক-লজ্জার বিষয়গুলো কিংবা ভুল ধারনা থেকে মানুষকে বের করে আনার। ধরুন কারও স্ট্রোক হলো। সেটিও ব্রেনের রোগ। এই রোগ হলে তো আমরা কাউকে পাগল বলি না। ঠিক তেমনি সিজোফ্রেনিয়াও একটি ব্রেনের রোগ।

অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম, চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে আলোচনার তৃতীয় পর্বে আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।  আর শ্রোতাবন্ধুরা! ব্রেনের কঠিন একটি রোগ সিজোফ্রেনিয়া যা মানসিক রোগ হিসেবে পরিগণিত সে সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা শুনলেন। আমাদের চারপাশে এই অনেক সিজোফ্রেনিয়া রোগী আছেন। তবে  চিকিৎসা করালে এ রোগ ভালো হয়ে যায়।

অনুষ্ঠানটির সাক্ষাৎকার গ্রহণ, উপস্থাপনা, তৈরি ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।#

ট্যাগ