নভেম্বর ০৫, ২০২৩ ১৬:১৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আসরেও আমরা আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনীর আগ্রাসন মোকাবিলায় ইরানি সৈন্যদের বীর বিক্রমে যুদ্ধ করার কিছু ঘটনা তুলে ধরব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা ও বীরত্বের কাহিনী নিয়ে অনেক বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। যুদ্ধের কোনো কোনো পর্যায়ে ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা প্রদর্শনের মাত্রা ছিল অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি এবং এ সময় আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরান সাফল্যও পেয়েছে অনেক। ইরানের তরুণ ও যুবক যোদ্ধারা যখনই দেখেছেন কোথাও চরম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং এই প্রতিরোধে প্রাণ চলেও যাওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে তারপরও তারা এ কাজে কখনও পিছপা হননি। ১৯৮০ সালে ইরাকি বাহিনী যখন ইরানে আগ্রাসন চালায় তখন ওই আগ্রাসন প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় সামর্থ্য ও প্রস্তুতি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর ছিল না।  যুদ্ধের এ পর্যায়ে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি গণবাহিনীর সদস্যরা ইরাকি সেনাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করতে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। তাদের প্রতিরোধের মুখে যে ইরাকি বাহিনী সাত দিনের মধ্যে গোটা ইরান দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল তারা আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। 

ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খোররামশাহর শহরে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকার খোররামশাহর দখল করার জন্য একটি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী পাঠায়। বাগদাদ আশা করেছিল, অরক্ষিত শহরটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দখল করা যাবে। ইরাক প্রথমে খোররামশাহর দখলের জন্য দুই ব্যাটেলিয়ন সেনা পাঠিয়েছিল। কিন্তু ইরানি যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তারা তাদের সেনা সংখ্যা বাড়াতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এই সেনার সংখ্যা দুই ডিভিশনে উন্নীত করতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক ইরাকি সেনার প্রাণহানির মাধ্যমে ৩৪ দিন পর আগ্রাসী বাহিনী এই শহরটি দখলে নিতে সক্ষম হয়। খোররামশাহর দখলের অভিযানে অংশগ্রহণকারী ইরাকি সেনা কমান্ডাররা এ সম্পর্কে পরবর্তীতে যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দেয় তাতে ইরানি যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের কিছুটা হলেও প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইরাকি সেনা কমান্ডারদের এসব স্বীকারোক্তি ‘দীর্ঘ যুদ্ধে খোররামশাহর’ শীর্ষক বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ওই বইয়ে ১৯৮০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষ সম্পর্কে একজন ইরাকি সেনা কমান্ডারের স্বীকারোক্তি এসেছে এভাবে: “অভিযান শুরুর আগে আমাদের জানানো হয়, খোররামশাহরে সামান্য কিছু ইরানি সৈন্য অবস্থান করছে যাদের মনোবল অত্যন্ত দুর্বল। কাজেই শহরটি দখল করতে কয়েক ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। ১৯৮০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় আমাদের সেনাদল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই দিক দিয়ে শহরটিতে হামলা চালায়। আমাদের অষ্টম ব্যাটেলিয়ান যখন পোলে নু’র ৫০০ মিটারের মধ্যে পৌঁছে যায় তখন ইরানি সৈন্যরা তাদের বাধা দেয় এবং সেখানে আমরা প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হই। সংঘর্ষস্থল থেকে কমান্ডিং পোস্টকে জানানো হয়, আমরা ইরানের পক্ষ থেকে হালকা অস্ত্র ও কামানের গোলার সম্মুখীন হচ্ছি। এ অবস্থায় তাদের সমর্থনে আরো দুই ব্যাটিলয়ান সেনা পাঠানো হয়।”

ওই ইরাকি সেনা কমান্ডার বলেন: “কিন্তু ইরানের পক্ষ থেকেও হামলার মাত্রা বেড়ে যায় এবং আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমাদের পক্ষে আমাদের সেনাদের লাশগুলি পর্যন্ত তুলে আনা সম্ভব হয়নি। আমাদেরকে আরেকবার হামলার নির্দেশ দেয়া হয় এবং আমরা তা পালন করি। কিন্তু দ্বিতীয়বারও আমরা পরাজয়ের সম্মুখীন হই।”

ইরাকের এই সেনা কর্মকর্তা ১৯৮০ সালের ১৫ অক্টোবরের সংঘর্ষ সম্পর্কে বলেন: “আমাদের সেনা ইউনিটগুলো ১৫ অক্টোবর সকাল সকাল রওনা হয়। আমাদের সেনাদের একাংশ সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারলেও প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার জানান, তারা ইরানের পক্ষ থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাদের পক্ষে সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, তার নেতৃত্বাধীন সেনাদলের অর্ধেকই নিহত হয়েছে, ফলে তাকে অবশিষ্ট সেনাদল নিয়ে বাধ্য হয়ে পিছু সরে আসতে হচ্ছে। অন্যদিকে ৪৯ ব্রিগেডের সেনারাও আমাদেরকে না জানিয়ে কিছুটা পশ্চাদপসরণ করে।”

ইরাকি এই সেনা কমান্ডার ১৯৮০ সালের ১৬ অক্টোবরের সংঘর্ষ বর্ণনা করেন এভাবে: “আমি আমার সেনা ইউনিটগুলোকে রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেই। কারন, ইরানিরা রাতের বেলায় তুলনামূলক কম প্রতিরোধ করে। আমার নির্দেশ অনুযায়ী সবগুলো ইউনিট যাত্রা শুরু করে। তবে প্রথম ইউনিটটি তুলনামূলক দ্রুত অগ্রসর হয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়।  কিছুক্ষণ পর ওই ইউনিটের কমান্ডার ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আমাদের জানায় যে, তারা ইরানিদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েছে এবং দ্রুত তাদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে না গেলে তাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এ সময় আমাদের একটি সুপ্রশিক্ষিত ইউনিটকে ইরানি সৈন্যদের অবরোধ ভাঙার জন্য পাঠানো হয় কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। তবে আমাদের ২৬তম ব্রিগেডের ব্যাপক কামান ও ট্যাংকের গোলাবর্ষণের ফলে বাম দিক দিয়ে ইরানিদের অবরোধ ভেঙে যায় এবং আমাদের ঘেরাও হয়ে পড়া ইউনিটটি কোনোমতে পশ্চাদপসরণ করে।   (মিউজিক)

ইরানি যোদ্ধারা এভাবে বীর বিক্রমে লড়াই করে প্রথমে আগ্রাসী বাহিনীর অগ্রাভিযান বন্ধ করে এবং এরপর দখলীকৃত এলাকাগুলো থেকে ইরাকি বাহিনীকে হটিয়ে দেয়। ইরাকিদের আগ্রাসনের প্রথম বার্ষিকীতে সামেন আল-আয়েম্মে অভিযান চালিয়ে আবাদান শহরের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার এবং ১৯৮২ সালের জুন মাসে বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযান চালিয়ে খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরান রক্ষণাত্মক কৌশল থেকে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় চলে যায়। 

এ পর্যায়ে ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি বাহিনীর ওপর ইরাকের মাটিতেই হামলা চালাতে শুরু করেন। তবে ইরাকের সাদ্দাম বাহিনীর সেনারা যখনই তাদের কোনো ভূখণ্ড হাতছাড়া করত তখনই পুনরায় সেনা সংগঠিত করে সেই ভূখণ্ড ইরানি যোদ্ধাদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাত। এ সময় ইরাকের বহু এলাকা ও শহর ইরানি যোদ্ধারা মাসের পর মাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং এটিকে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের অন্যতম বড় সাফল্য বলে বিবেচনা করা হয়।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ