নভেম্বর ১৪, ২০২৩ ১৮:৩৯ Asia/Dhaka

আপনারা জানেন যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রধান কাজ হচ্ছে যেকোনো ঘটনাকে উল্টো করে তুলে ধরা। দর্শক-শ্রোতা-পাঠককে উত্তেজিত করে জনমতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে এসব গণমাধ্যমের জুড়ি নেই।

আজকের আসরে আমরা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বাধানো ও বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ বাধাতে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালনার করার শক্তি গণমাধ্যমের রয়েছে। যেকোনো গণমাধ্যম এই শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের নীতি নির্ধারকদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জনমত পরিচালিত করে। এর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে। এসব গণমাধ্যম বহু বছর ধরে নানারকম কৌশল অবলম্বন করে জনমতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এসব গণমাধ্যমকে খুব কমই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কোনা ঘটনা সম্পর্কে সঠিক চিত্র তুলে ধরতে দেখা যায়; কিন্তু তারপরও পশ্চিমা জনমত এসব গণমাধ্যমের পক্ষেই রয়েছে।  বিশ্ব জনমতও পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রচারণায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রয়েছে।

এ থেকে বোঝা যায়, প্রযুক্তির বিকাশের ফলে যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার সুযোগ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও বিশ্লেষণের ছলচাতুরি ধরতে পারার ক্ষমতা মানুষের কমে গেছে। ফলে মানুষের পক্ষে এখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সবচেয়ে সহজ মিথ্যাটিও আর শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না যা বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষক এলিজাবেথ উইলিয়ামসন এ সম্পর্কে বলেন: গণমাধ্যমে বাস্তব তথ্য উপস্থাপনের যুগ শেষ হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক সংবাদের ক্ষেত্রে পশ্চিমা গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি মিথ্যাচার করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরাধ কিংবা বিজ্ঞান বিষয়ক খবরের তুলনায় রাজনৈতিক খবরে ভুয়া তথ্য বেশি সংযোজন  করা হয়। ২০১৮ সালে সায়েন্স ম্যাগাজিনে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় যা এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করে। এই গবেষণার ফলাফলের সবচেয়ে মজার দিকটি ছিল, গণমাধ্যমে প্রকাশিত মিথ্যাচার সম্পর্কে পাঠক, দর্শক ও শ্রোতার কোনো মাথাব্যথা নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত মিথ্যা ও ভুয়া খবরগুলোকে রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী বিলাসবহুল গাড়ির সঙ্গে তুলনা করা যায়। পাশাপাশি কোনো মিথ্যাচার ধরা পড়ে গেলে সেজন্য যে সংশোধনী প্রকাশিত হয় তাকে রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী ভাঙাচোড়া গাড়ির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।স্বা ভাবিকভাাবেই মানুষের দৃষ্টি বিলাসবহুল গাড়ির দিকেই থাকবে; ভাঙাচোড়া গাড়ির দিকে নয়।

সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার ব্যবহারকারীদের কাছে বাস্তব সত্য পৌঁছাতে মিথ্যা তথ্যের চেয়ে ৬ গুণ বেশি সময় লাগে। বেশিরভাগ টুইটার ব্যবহারকারী সত্য-মিথ্যার পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারেন না; কারণ, কোনো ঘটনা সম্পর্কে এত বেশি তথ্য তারা পান যা পরীক্ষা করে যাচাই করার সুযোগ তাদের থাকে না। এমনকি তারা যদি যেকোনো তথ্যের জন্য শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল থাকেন তারপরও তারা এই অবস্থা থেকে মুক্তি পান না; কারণ, নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমগুলিতেও মিথ্যা তথ্য ছড়াতে পারে, এমনকি তারাও মিথ্যার জন্ম দিতে পারে।

২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সিরিয়ায় একটি গুজব অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ছড়িয়ে দেওয়া হয় যা দেশটির গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি ছিল সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী একদল ছাত্রের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশন যারা তাদের স্কুলে দামেস্কের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান লিখেছিল। কাতার-ভিত্তিক নিউজ চ্যানেল আল-জাযিরা অপেশাদার আচরণ করে ওই ঘটনার ব্যাপারে এমন কিছু সাক্ষাৎকার প্রচার করে যার সত্যতা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। আল-জাযিরা দাবি করে, তাদের কাছে টেলিফোন করে সিরিয়ার এক ব্যক্তি বলেছেন, “দেশটির পুলিশ দামেস্কের দক্ষিণে অবস্থিত দারা শহর থেকে ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশুদের আটক করেছে। এসব শিশু টেলিভিশনে দেখেছিল, অন্যান্য আরব দেশের জনগণ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। শিশুরা ওইসব দেশের সেই স্বাধীনতাকামী স্লোগানগুলো তাদের স্কুলের দেওয়ালে লিখতে শুরু করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ এসব শিশুকে ধরে নিয়ে যায়।”

আল-জাযিরার নিউজের সূত্র ধরে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এ সংক্রান্ত খবর প্রচার করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা দাবি করে, সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া এসব শিশুকে চরম নির্যাতন করে নিরাপত্তা বাহিনী। এ খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে দারা শহরে বড় ধরনের দাঙ্গা বেধে যায়। সিরিয়ার সরকারি কাঠামোতে সমস্যা থাকার কারণে দারা শহরের সে দাঙ্গা অতি দ্রুত গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ছোট একটি ঘটনাকে বিকৃতভাবে তুলে ধরার ফলে সৃষ্ট সেই গৃহযুদ্ধ প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয় এবং এতে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পাশাপাশি এক কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয় এবং সিরিয়ার অবকাঠামো প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।

পরবর্তীতে তদন্ত করে দেখা যায়, পুলিশ যাদেরকে আটক করেছিল তারা যেমন শিশু ছিল না তেমনি যাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছিল বলে খবর প্রচার করা হয়েছিল তারাও শিশু ছিল না। পরবর্তীতে সিরিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওইসব আটক ব্যক্তিদের একজন একথার সত্যতা স্বীকার করেন যে, সিরিয়ার জনগণ গণমাধ্যমের বিকৃত তৎপরতার মাধ্যমে সৃষ্ট একটি গৃহযুদ্ধের শিকার হয়েছে। আর ওই তৎপরতার মূলে ছিল একটি ভুয়া খবর।

অনুসন্ধানমূলক ওয়েবসাইট উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এ সম্পর্কে বলেন: “আমি যেসব গুরুত্বপূর্ণ সত্য উদঘাটন করেছি তার একটি হচ্ছে, বিগত ৫০ বছরে বিশ্বে যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রায় সবগুলো গণমাধ্যমের মিথ্যাচারের কারণে শুরু হয়েছে। এসব যুদ্ধ গণমাধ্যমগুলোই ইচ্ছা করলে বন্ধ করতে পারত। কোনো দেশের জনগণ যুদ্ধ চায় না এবং যুদ্ধে যেতেও চায় না। অথচ এই জনগণকে ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধে নেওয়া হয় এবং তাদেরকে এমনভাবে উত্তেজিত করা হয় যে, তারা চোখ বন্ধ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর অর্থ হচ্ছে, যদি গণমাধ্যমের পরিবেশ ভালো থাকত তাহলে বিশ্বে একটি শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করত।  

এবারে আসা যাক, ইরাকের ঘটনায়। ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইরাক আমেরিকার কাছে সব সময় কৌশলগত গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে ইরাকে নিজের সামরিক উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে এসেছে। ২০০৩ সালে মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন সেনাদের ইরাক আগ্রাসনে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো প্রধান সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গণমাধ্যম ওয়াশিংটনের পক্ষ না নিলে মার্কিন জনগণকে এত সহজে ইরাক আগ্রাসনের পক্ষে রাজি করানো সম্ভব ছিল না।

ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে দাবি করে আমেরিকা ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন চালায়। বিভিন্ন রিপোর্টে জানা যায়, মার্কিন সেনাবাহিনী সেসময় নিজে সরাসরি মিথ্যা প্রচারণা না চালিয়ে একটি প্রোপাগান্ডা কোম্পানি নিয়োগ দেয়।  লিঙ্কেন নামের ওই কোম্পানির কাজ ছিল ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কল্পকাহিনী তৈরি করে তা ইরাকি গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারের ব্যবস্থা করা।

ইরাকের একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান হাসান আর-রাবিয়ি তার দেশে মার্কিন হামলার ক্ষেত্র সৃষ্টি করার কাজে গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন: ২০০৩ সালের আগে মার্কিনীরা ইরাক আগ্রাসনের লক্ষ্যে তিনটি বড় ধরনের মিথ্যা প্রচার করে। এক- সাদ্দাম সরকারের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, দুই- ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ইরাকের হাত ছিল এবং তিন- আল-কায়েদার সঙ্গে ইরাকের সম্পর্ক রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইরাকি জনগণের জন্য কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার ওই আগ্রাসনের ফলে ইরাকি জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, দেশটির অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়, লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়। যুদ্ধ শেষে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইরাকের পুনর্গঠনের জন্য ১১২ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ২০০ কোটি ডলার প্রয়োজন।

২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পরের মাসেই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। ওই আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ২০ বছরের বিদেশি দখলদারিত্বের সময় নিরপরাধ আফগান জনগণের রক্তপাত ছাড়াও দেশটিতে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। আমেরিকার আফগানিস্তান আগ্রাসনকে বৈধতা দিতেও মার্কিন গণমাধ্যম নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এই গণমাধ্যমের কল্যাণে আমেরিকা ২০ বছর ধরে আফগান জনগণকে হত্যা করা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী মানুষ জেনেছে, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, আজকের মতো এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

ট্যাগ