ডিসেম্বর ০৪, ২০২৩ ২০:১২ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-১৫)

গত আসরে আমরা ইরানের অর্থনৈতিক খাতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা বিগত চার দশক ধরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে ইরানের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করব। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো বলে আশা রাখছি।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর এদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পাশাপাশি অপপ্রচার ও অনুপ্রবেশকে ইরানি জাতির ওপর চাপ সৃষ্টি করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকা। ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একদল শিক্ষার্থী তেহরানস্থ তৎকালীন মার্কিন দূতাবাস দখল করার পর তেহরানের বিরুদ্ধে প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন। মার্কিন দূতাবাসে বসে ইরানবিরোধী ষড়যন্ত্র করা হয় বলে শিক্ষার্থীরা সেটিকে দখল করে এবং পরবর্তীতে ওই দূতাবাসকে ‘গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) শিক্ষার্থীদের দূতাবাস দখলের ঘটনা সমর্থন করেন। তিনি এ ঘটনাকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এই বিপ্লবের মর্যাদা প্রথম বিপ্লবের চেয়েও বেশি।

দখলীকৃত মার্কিন দূতাবাস থেকে উদ্ধার করা নথিপত্রে দেখা গেছে, ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর থেকেই মার্কিন কূটনীতিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্বের ছদ্মাবরণে ইরানে দাঙ্গা ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। এই খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর  বিশ্বের অনেক দেশ মার্কিন দূতাবাসগুলোর নাশকতামূলক তৎপরতার ব্যাপারে সচেতন হয়ে যায়। ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দামের পতনের পর বাগদাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন নিগ্রোপন্টে একজন ইরাকি কর্মকর্তাকে বলেছিলেন: আপনি জানেন কি আমেরিকায় কেন কখনও অভ্যুত্থান হয় না? তিনি নিজেই ওই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলেন: এর কারণ, হচ্ছে ওয়াশিংটনে মার্কিন দূতাবাস নেই! এই কথা বলে নিগ্রোপন্টে অকপটে একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বিশ্বের যে দেশেই অভ্যুত্থান হোক না কেন তাতে মার্কিন সরকারের হাত থাকে।

তেহরানে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া দখলের পর আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইরানের বিরুদ্ধে প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন পণবন্দিদের মুক্তি দেয়া হলে ‘আলজেরিয়া ঘোষণা’ অনুযায়ী, ইরানের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার কথা ছিল। কিন্তু ওয়াশিংটন তা করেনি। কথা ছিল মার্কিন পণবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হলে মার্কিন সরকার দেশটিতে আটককৃত ইরানের সম্পদ তেহরানকে ফেরত দেবে এবং শাহের আমলে পরিশোধকৃত অর্থের বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী ইরানকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করবে। কিন্তু ওই চুক্তিও লঙ্ঘন করে ওয়াশিংটন।

পরের বছরগুলোতে ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপ্তি আরো বেড়ে যায়।  প্রকৃতপক্ষে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তে অটল থাকে মার্কিন সরকার; তবে অজুহাত পাল্টে যায় মাত্র। পরবর্তীতে ইরানের ওপর যেসব কারণে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কথিত সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থন এবং পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি। সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থন বলতে ফিলিস্তিনসহ স্বাধীনতাকামী জাতিগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থনকে বোঝানো হয়। 

বর্তমানে ইরানের অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই যেখানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ নেই। আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো ইরানের বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। এমনকি ২০২০ সালে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মতো ইরানকেও যখন করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তখনও আমেরিকা ইরানকে ছাড় দিতে রাজি হয়নি। মার্কিন সরকার মুখে দাবি করেছে, তারা খাদ্য ও ওষুধের মতো অতি জরুরি পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি কিন্তু বাস্তবে ইরানকে বহির্বিশ্ব থেকে করোনার টিকা আমদানি করতে বাধা দিয়েছে। ইরানি বিশেষজ্ঞরা নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে যতদিন পর্যন্ত করোনার টিকা আবিষ্কার করতে পারেননি ততদিন ওই টিকা আমদানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। ইরান যখন নিজস্ব গবেষণালব্ধ টিকা ব্যবহার করতে শুরু করে তখন ওই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়।

এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি যে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ’ করা সত্ত্বেও ইরানকে নতজানু হতে বাধ্য করতে পারেননি। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় আগে আমেরিকা ইরানের পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ইরান তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবাদী ইসরাইলের পক্ষে লবিস্ট হিসেবে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা জি. স্ট্রিট বলেছে, পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে আসার পাঁচ বছর পর এখন সময় এসেছে একথা স্বীকার করার যে, ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি ব্যর্থ হয়েছে।

পাশ্চাত্যের ভয়াবহ এসব নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করে উন্নতি তো দূরের কথা টিকে থাকাই অন্য যেকোনো দেশের জন্য দুরুহ ব্যাপার হয়ে যেত। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর ভাষায়, “ইরান নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাত মঞ্জিল পথ অতিক্রম করেছে। অন্য কোনো দেশ হলে তার পক্ষে এক মঞ্জিলও অতিক্রম করা সম্ভব হতো না।” ইরানি জনগণ মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে ও তাঁর প্রতি ঈমান অটুট রেখে এবং সর্বোচ্চ নেতার দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। আজ অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও গবেষণা এবং সামরিক দিকসহ সকল ক্ষেত্রে ইরানের উন্নতি চোখে পড়ার মতো।

শ্রোতাবন্ধুরা, ঘটনার নেপথ্যে ধারাবাহিকের শেষ পর্বের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি আমরা।  ১৫ পর্বের এই অনুষ্ঠানে আমরা বর্তমান যুগে ভার্চুয়াল জগতের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছি, আধিপত্যকামী শক্তিগুলো এই জগত ব্যবহার করে তুলনামূলক অনেক কম খরচে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে এই বলে যে, এসব গণমাধ্যম সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনমত গঠন করে দেয়। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের যুদ্ধকে বলা হয় নরম যুদ্ধ বা সফট ওয়ার। গণমাধ্যম বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০২২ সালে ইরানের বিরুদ্ধে বিদেশি মদদে যে সহিংসতা চাপিয়ে দেওয়া হয় তা ছিল একটি দেশের পক্ষ থেকে আরেক দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম বিশ্ব সাইবার যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাজেই এ ধরনের যুদ্ধ থেকে নিরাপদ থাকতে হলে যেকোনো দেশের জনগণের মধ্যে গণমাধ্যম বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে হবে। তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। শুরুতেই যেমনটি বলেছিলাম আজ ঘটনার নেপথ্যে অনুষ্ঠানটি শেষ হতে যাচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে নতুন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

 

 

ট্যাগ