অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-৮)
বেন ফালকুরাহ নামে অন্য আরেকজন ইহুদি দার্শনিক নিজের হিব্রু ভাষায় লেখা গ্রন্থে ফারাবির রচনা থেকে সরাসরি বেশ কিছু অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছেন, যা থেকে ফারাবির চিন্তাদর্শনের সাথে তার গভীর পরিচিতির বিষয়টি ফুটে ওঠে। তিনি একজন ইহুদি হয়েও ফারাবির মূল্যবোধের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বেন ফালকুরা তার বই "দ্য বিগিনিং অফ সায়েন্স" এর দ্বিতীয় অংশ 'বিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাস' নামে একটি অধ্যায়ে যা কিছু লিখেছেন তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় তিনি ফারাবির লেখা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
ইহুদি পণ্ডিত বেন ফালকুরাহ দর্শনের ওপর ফারাবির তিনটি প্রধান গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ হিব্রু ভাষায় রূপান্তর করেছিলেন। এই তিনটি গ্রন্থের মধ্যে ছিল 'তাহসিল আল-সাআদা', 'প্লেটোর দর্শন' এবং 'ফারাবির অ্যারিস্টটলীয় দর্শন যা প্রায় সমস্ত ইহুদি বুদ্ধিজীবী মহলকে প্রভাবিত করেছিল। রূপান্তর করা এ বইগুলো এতোই জনপ্রিয় ছিল যে বেন ফালকুরাহ-এর মৃত্যুর পর দুই বা তিন শত ধরে এ তিনটি বই ইহুদি চিন্তাশীল মহলে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বেন ফালকুরাহ ফারাবীর রচনাগুলো সংগ্রহ করা এবং তা হিব্রু ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক কাজ করেছেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার সেসমস্ত রচনা আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। আমরা জানি যে এগুলো ফারাবির রচনার সম্পূর্ণ অনুবাদ কিংবা স্বাধীন বা স্বতন্ত্র এমন কোনো গ্রন্থ ছিল না যাতে ফারাবির পূর্ণ মতামত উঠে আসে। তবে, সংক্ষেপে রূপান্তরিত এসব বইয়ের কিছু অংশে ফারাবির গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো স্থান পেয়েছে।
এ ছাড়া, আল-ফারাবির 'এহসা আল-উলূম' বইটি খ্রিষ্টীয় ১৩১৪ সালে ইবনে কালুনিমুস বেন কালুনিমুস হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন যাতে আরবি ভাষা না জানা হিব্রু ভাষাভাষীরাও ফারাবির লেখা থেকে উপকৃত হতে পারেন। এ থেকেও ইহুদি দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের মধ্যে ফারাবির ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। ইবনে কালুনিমুস ফারাবির "An Introduction to Aristotle" নামক আরেকটি গ্রন্থ হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু এই অনুবাদে তিনি ফারাবির গ্রন্থের আরবি পাঠের প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি ফারাবীর গ্রন্থ অনুবাদে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সমন্বয় করেছেন এবং এমনকি তার কিছু ব্যক্তিগত মতামত যুক্ত করেছেন যার মধ্যে ওষুধ, অ্যালকেমি ও জাদু শিল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইবনে কালুনিমুসের অনুবাদ সম্পর্কে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলা যেতে পারে যে, তার অনুবাদগুলো ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল এবং ফারাবিকে তারা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতো। এই ধারা খ্রিস্টীয় ১৪ শতক থেকে ১৫ শতকের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
যুক্তিবিদ্যায় আরো কিছু ইহুদি পণ্ডিতের ওপর ফারাবীর প্রভাব ব্যাপকমাত্রায় লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ইবনে মায়মন ফারাবীর জ্ঞানের গভীরতা এবং তার লেখনীশক্তির আশ্চর্যজনক ক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত 'মাকালে ফি সানায়ে আল মানতেক্ব' গ্রন্থ ইবনে মায়মনকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছিল। ১১৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত এই গ্রন্থটি ইহুদি দার্শনিকদের মধ্যে ফারাবির যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায়। আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার এই গ্রন্থ দ্বারাই যে কেবল ইবনে মাইমন প্রভাবিত হয়েছিলেন তা নয় বরং এই ইহুদি দার্শনিকের অন্যান্য কাজ ও রচনাবলী থেকেও আল-ফারাবির ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমা গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ইবনে মাইমন ফারাবির যুক্তিবিদ্যা ভালোভাবে জানতেন এবং তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন। ফারাবীর মতামত উদ্ধৃত করা ছাড়াও তিনি তার রচনাগুলোতে ফারাবির কিছু বিষয় পুনরায় উল্লেখ করেছেন এবং কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন করেছেন ইহুদি পাঠকদের সহজে উপলব্ধির জন্য।
পূর্ব ইউরোপের সাথে মুসলমানদের ক্রুসেড যুদ্ধের প্রভাবে আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত রচনাগুলো হিব্রু ভাষায় অনুবাদের বিষয়টি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই অনুবাদগুলোর সংখ্যা একেবারে কম নয় এবং সেগুলো বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছিল যা কিনা ইহুদি সমাজে ফারাবির যুক্তিবিদ্যার ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের প্রমাণ। তবে, পশ্চিমা পণ্ডিতরা সম্প্রতি হিব্রু ভাষায় অনুবাদগুলোকে প্রধানত ফারাবির মতের অনুবাদ এবং অ্যারিস্টটলের অর্গাননের ধারণা ব্যাখ্যাকারী ছোট গ্রন্থের অনুবাদ বলে মনে করছেন যা বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়কালে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম দিকের এই অনুবাদগুলো ছিল খুবই উন্নত এবং প্রকৃতপক্ষে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে তা অনুবাদ করা হয়েছিল। এই অনুবাদগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তা ছিল স্প্যানিশ ইহুদিদের সাথে সম্পর্কিত। এ ছাড়া, স্যামুয়েল ইবনে তাইবুন এবং তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ উত্তরসূরিদের মাধ্যমেও ফারাবির রচনাগুলো অনুবাদ করা হয়েছিল৷ এই অনুবাদগুলো ছিল ১৩ শতকের এবং ১৪ ও ১৫ শতকে ইহুদি দার্শনিকদের মধ্যে তা সাড়া ফেলেছিল। এভিগডোর ছিলেন একজন বিখ্যাত ইহুদি যিনি ফারাবির এই যুক্তিবিদ্যার কাজের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন।
এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার তথাকথিত ফারাবী ব্যাখ্যাও মাশা ইহুদিদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরও মজার ব্যাপার হল, ইহুদিদের হিব্রু ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধরন থেকে ফারাবির যুক্তিবিদ্যার প্রভাব উপলব্ধি করা যায়। এই বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিকের যুক্তিবিদ্যার উপর আরো অনেক গবেষণা ও চরনাসামগ্রী ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তার কিছু আরবি অংশ হারিয়ে গেছে, তবে হারিয়ে যাওয়া সেসবের কিছু অংশ আবার ইহুদি দার্শনিকদের লেখনীর মধ্যে রয়ে গেছে।
আরবী ভাষায় লেখা যুক্তিবিদ্যার ওপর ফারাবির যে গ্রন্থগুলোর কিছু অংশ হারিয়ে গেছে হয়তোবা হিব্রু ভাষায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং অনুবাদের মধ্যে সেসব খুঁজে পাওয়া যাবে। ফারাবির বিখ্যাত 'মদীনা আল-ফাজালাহবাসীদের মতামত' বইটির কথা ইহুদিরা বহুবার উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে, মূসা ইবনে ইজরা তার গ্রন্থে ফারাবির ওই বইয়ের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন। এছাড়াও, ইসহাক বিন লতিফ এবং ফালকুরাহ তাদের 'দারাজত' বা 'ডিগ্রীস' গ্রন্থে ফারাবীর এই বইয়ের কিছু বিষয় ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে অধিবিদ্যা এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে।
আল-মদিনা ইউটোপিয়া বিষয়ে আল-ফারাবির বইটি হিব্রুতে অনুবাদ করা হয়নি, তবে তার 'আল-সিয়াসা আল-মদীনা' বইটি হিব্রুতে অনুবাদ করেছেন মুসা বিন তাইবুন। এই অনুবাদটি প্রমাণ করে যে ফারাবির এই গবেষণা ও রচনাসামগ্রী বহু ইহুদি চিন্তাবিদকে প্রভাবিত করেছিল।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।