নভেম্বর ১৫, ২০২৩ ২১:২০ Asia/Dhaka

পাশ্চাত্য ও আমেরিকায় যে কুৎসিত ও ঘৃণ্য কাজগুলো প্রচলিত নারী ও মেয়েদের নিপীড়ন সেসবের অন্যতম। এসব দেশে নারী নির্যাতনের মর্মান্তিক ও আতঙ্কজনক পরিসংখ্যান রয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক নারী তাদের স্বামীদের হাতে নির্যাতিত হন। আর অনেক মেয়ে তাদের বাবার হাতে প্রহৃত হয়ে আহত হয়। পাশ্চাত্যের বিপথগামী সংস্কৃতিতে নারী নির্যাতন মানবজাতির ইতিহাসে নজিরবিহীন।

পশ্চিমারা জীবনের সব ক্ষেত্রে,- বিজ্ঞান, শ্রম ও শিল্প-সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে নারীর ওপর জুলুম করেছে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করেছে। ইউরোপীয় সংস্কৃতির দৃষ্টিতে, মধ্যযুগ থেকে এবং পরবর্তীতে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, নারী ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে পাশ্চাত্যে বড় বড় কলকারখানার প্রচলন ঘটে। এ সময় পশ্চিমা পুঁজিবাদীরা কম মুজুরির এমন শ্রমিক খুঁজতে থাকে যারা উচ্চাভিলাষী হবে না ও যাদের নিয়ে ঝামেলাও হবে কম। ফলে নারীদের সামনে স্বাধীনতার শ্লোগান দেয়া হল যাতে তারা এতে প্রতারিত হয়ে ঘর থেকে বের হন এবং কল-কারখানায় কম বেতনে কাজ করেন! 

ব্রিটেনে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষিত নারীদের সার্টিফিকেট বা সনদ দেয়া হত না। সে সময় বলা হত মেয়েদেরকে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দেয়া উচিত নয়। বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত পাশ্চাত্যে নারীর ভোটাধিকার ছিল না। একই শতকের প্রথম দিকে পশ্চিমা নারীরা সম্পদের অধিকারী হলেও নিজের সম্পদ স্বাধীনভাবে ব্যবহারের অধিকার রাখত না। সম্পত্তি তাদের স্বামী বা পিতা বা ভাইয়ের দখলে থাকতো। 


একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত, সমস্ত ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশ ও আমেরিকাতে, নারীরা ছিল পুরুষদের কর্তৃত্বাধীন এবং একটি সভ্য সমাজে মানুষের যেসব মৌলিক অধিকার রয়েছে সেসবের কোনটিই তাদের ছিল না। আজও, পাশ্চাত্যে একজন নারীর সমাজে উপস্থিতি নির্ভর করছে কিভাবে সে নিজেকে পুরুষের জন্য কত বেশি তৃপ্তিদায়ক করে তুলছে তার ওপর। এভাবে নারী এখনও সেখানে শোষণের শিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে স্ত্রীরা স্বামীর হাতে ও কন্যারা পিতার হাতে মারধোরের শিকার হচ্ছে। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ নারী পুরুষের হাতে চড় বা কিল-ঘুষি খাচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ শিল্প-উন্নত দেশগুলোতেই বেশি। 

 এসব অবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে পাশ্চাত্যে এখনও সেই প্রাচীন রোম বা গ্রিসের নারীদের মত বৈষম্য ও অবিচারের শিকার হচ্ছে নারী! নারী সেই যুগের মতই এখনও অসম্মানের শিকার। এখনও পশ্চিমা নারী  পুরুষের যৌন চাহিদা মেটানোর মাধ্যম মাত্র! যৌন স্বাধীনতার নামে সেখানে শোষিত হচ্ছে নারী! আজও তারা যৌন দাসীর চেয়ে বেশি কিছু নয়!

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ব্রিটেনে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক চার নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কেবল ২০২২ সালের মার্চ মাসেই ধর্ষণের ৭০ হাজার ৩৩০টি ঘটনার তথ্য এসেছে পুলিশের কাছে। ওয়েলস ও ইংল্যান্ডে প্রতি বছর ৮৫ হাজার নারী ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও গড়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৬৩৪ জন নারী  ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৫ জন মার্কিন নারীর একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়াও প্রতি বছর হাজার হাজার নিরপরাধ নারী মার্কিন পুলিশের হামলায় হতাহত হচ্ছেন। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খামারগুলোতে কাজ করছে ত্রিশ লাখেরও বেশি নারী। এদের মধ্যে প্রায় ৬৩ হাজার অভিবাসী ও অনেকেই অবৈধভাবে সেদেশে এসেছেন। এই নারীরা অন্তত একবার তাদের মালিক বা নিয়োগ-কর্তাদের হাতে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মস্থলে নারীরা যেসব নির্যাতনের শিকার হন সেসবের মধ্যে রয়েছে মারধোর, যৌন-নির্যাতন এবং এমনকি হত্যাকাণ্ড!


ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক এন্থনি গিডেনস 'সমাজবিদ্যা' নামক বইয়ে লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চার জন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন বিশ্বাস করেন যে স্ত্রীকে পেটানোর যৌক্তিক কারণ রয়েছে স্বামীর কাছে! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ইউরোপের ১৬ থেকে ৪৪ বছর বয়স্ক নারীরা ক্যান্সার, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে যতটা কষ্ট পান তার চেয়েও বেশি মাত্রায় সহিংসতার শিকার হচ্ছেন পরিবারের মধ্যেই! বিশ্বের পারিবারিক সহিংসতাগুলোর ৯০ শতাংশেরই শিকার হচ্ছে নারী! বিশ্বে প্রতি ১৮ সেকেন্ডে প্রাণ হারাচ্ছেন একজন নারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি ১৮ সেকেন্ডে একজন নারী খারাপ আচরণ বা হামলার শিকার হচ্ছেন।– 

অতীত যুগে মানুষকে পাচার করে দাস বানানো হত। কিন্তু বর্তমান যুগেও ইউরোপ-আমেরিকায় নারী ও মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে। অস্ত্র, মাদক ও মানুষ পাচার বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক অবৈধ ব্যবসা। মানব পাচার করা হচ্ছে যৌন বাণিজ্যের জন্য। গত বিশ বছরে এই ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। যৌন কাজে মানব পাচারের মাধ্যমে বিশ্বে অসাধু ব্যবসায়ীরা আয় করছেন প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি ইউরো।

পশ্চিমা সমাজে নারীর দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, পশ্চিমারা ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার মুনাফার জন্য নারীকে এমন অবস্থায় নামিয়ে এনেছে যে সেখানে লোভী ও প্রবৃত্তি-পূজারি পুরুষরা রাস্তাঘাটেই দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে বা অন্য কোনো মাধ্যমে যৌন তৃপ্তি লাভ করছে! এভাবে তারা নারীর সম্ভ্রম ও সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে!  সেখানকার পরিবেশই এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে খোদ নারী সমাজই তথা প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও মেয়েরা  এমনভাবে সেজে চলতে পছন্দ করে যে তাদের শারীরিক ভিন্নতার নগ্ন প্রকাশ যেন পরপুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। তাও আবার কোন্ ধরনের পরপুরুষ? যেসব পুরুষ পথে ঘাটে চলাফেরা করছেন! এভাবে পাশ্চাত্যই নারীর ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে!    
  

প্রখ্যাত মার্কিন গায়িকা ম্যাডোনা পাশ্চাত্যে নারীর অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, আমি যখন প্রথমবার ১৯৭৯ সনে নিউইয়র্কে আসি তখন সেটা ছিল ( কেবল নারীদের জন্য?) এক ভয়ানক স্থান। সে বছরই অস্ত্র দেখিয়ে আমাকে হুমকি দিয়েছিল অনেকেই। আমার গলার ওপর ছুরি রেখে একটি বাড়ির ছাদে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। বার বার আমার ঘরে ভাঙ্গচুর করা হয়েছে, দরজা ভেঙ্গে চুরি করেছে চোরেরা। ফলে আমি আর ঘরের দরজায় তালা লাগাতাম না! মডেল হিসেবে আর্টের ছাত্রদের জন্য আমার যেসব ছবি তোলা হত সে জন্য আমি অর্থ পেতাম! সবার প্রত্যাশা ছিল এটা যে এসব ছবি প্রকাশ হলে আমি লজ্জা পাব! কিন্তু আমি লজ্জা অনুভব করতাম না! ফলে সবাই হতবাক হয়েছিল! এরপর ধীরে ধীরে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। কারণ যাকে বিয়ে করেছিলাম সে আমাকে মারধোর করত! কাজের বাজারেও আমি একঘরে হয়ে পড়ি।...

ম্যাডোনা আরও বলছিলেন, এখন বছরের সেরা নারী (গায়িকা) হিসেবে পুরস্কার নেয়ার সময় ভাবছি সঙ্গীত ব্যবসায় নারী ও নারী প্রসঙ্গে কি বলতে পারি?  আগে গান লেখার সময় আমি নারীবাদ নিয়ে ভাবতাম না, কেবলই শিল্পী হতে চেয়েছি।.... এখন বুঝতে পারছি যে নারী হলে কোনো স্বাধীনতা নেই! নারীকে সুন্দরী ও আকর্ষণীয় হওয়ার অনুমতি দেয়া হয় কিন্তু বুদ্ধিমতী হওয়ার ও মতামত দেয়ার অধিকার তাদের নেই! বিরাজমান পরিস্থিতির বিপরীতে মত প্রকাশের কোনো অধিকার তাদের নেই! পুরুষরা তাদের সঙ্গে বস্তু বা পণ্যের মতো আচরণ করতে পারে। নারীরা পতিতাদের মত পোশাক পরতে পারে, কিন্তু কোনো অধিকার বা ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। লৈঙ্গিক কল্পনা বা আদর্শ দুনিয়ায় তারা শেয়ার করতে পারে না বা সেসব শেয়ারের অধিকার তাদের নেই! তারা কেবল তেমনই হতে পারে যেমনটি পুরুষরা নারীদের কাছে চায়! আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল তাদেরকে তেমনই হতে হবে যেমনটি হলে পুরুষরা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। ...#

পার্সটুডে/এমএএইচ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ