নভেম্বর ১৯, ২০২৩ ১৭:০১ Asia/Dhaka
  • গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন: তুরস্কসহ আরব দেশগুলোর ভূমিকা (পর্ব-দুই)

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের ব্যাপারে তুরস্কের অবস্থান নিয়ে কথা বলেছি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, 'ইসরাইল পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ছাড়া তিন দিনও টিকতে পারবে না, আমরা বিশ্বের কাছে ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে উপস্থাপন করবো এবং গাজায় এখন যা ঘটছে তা ইসরাইলের আত্মরক্ষা নয় বরং নৃশংস হত্যাকাণ্ড।'

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে প্রথমে হামাসের প্রতি জোরালো সমর্থন দেন এবং দ্বিতীয়ত, পশ্চিমাদের কথিত মানবাধিকারের দাবী নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। একই সাথে তিনি মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক আচরণেরও অভিযোগ তোলেন। তৃতীয়ত, প্রেসিডেন্ট এরদোগান মার্কিন সরকারকে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের অংশীদার হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং চতুর্থত, তিনি ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন এসব অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা যেতে পারে।

নিঃসন্দেহে গাজার জনগণের পক্ষে এরদোগানের এসব বক্তব্য প্রশংসনীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুরস্কের অভ্যন্তরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন এরদোগান। বাস্তবতা হচ্ছে, গাজার সমর্থনে তুর্কি জনগণের বিক্ষোভ সমাবেশ তীব্রতর হওয়ার পর এরদোগান ফিলিস্তিনের পক্ষ অবস্থান নেন। অন্য কথায় বলা যায়, তুর্কি জনগণ এবং দেশটির বুদ্ধিজীবী মহল ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও প্রেসিডেন্ট এরদোগান অনেক হিসাব-নিকাশ এবং বিচার-বিবেচনা করে, অবশেষে গাজার প্রতিরক্ষা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন এবং ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের নিন্দা জানাতে বাধ্য হন। আগামী মার্চে তুরস্কের বিভিন্ন শহরের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই অনেকের মতে, গাজাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন এরদোগান। এর আগেও এরদোগান বেশ কয়েকটি জনসমাবেশে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের কথা বলে ভোট লাভের চেষ্টা করেছেন। তুর্কি দৈনিক জমহুরিয়াতের বিশ্লেষক ওরহান বোরসালি বলেছেন, 'এরদোগান জানেন যে হামাস তুর্কি নাগরিকের কাছে জনপ্রিয় এবং এই কারণে, এরদোগান হামাসের প্রতি সমর্থনকে নির্বাচনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন।'  

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞ মোকাবেলা করতে এবং ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার জন্য আরব দেশ ও তুরস্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপ নিতে পারে তার মধ্যে একটি হল, বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইসরাইলের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করা। ২০২০ সাল থেকে মার্কিন সরকারের মধ্যস্থতায়, কিছু আরব দেশের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে, সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছিল এবং এমনকি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা করেছিলেন যে আমরা আগের চেয়ে স্বাভাবিকীকরণের অনেক কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছি। তুরস্ক সরকারও ২০২২ সাল থেকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের পদক্ষেপ নেয়।  ১৩ বছর আগে, ২০১০ সালে, ইসরাইল তুরস্কের মাভি মারমারা জাহাজে হামলা চালিয়ে ৯ তুর্কি নাগরিককে হত্যা করার পর, আঙ্কারা এবং তেল আবিবের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হয় এবং দুপক্ষের কূটনৈতিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়েছিল। 

এরপর, ২০১৮ সালে গাজার বাসিন্দাদের হত্যার প্রতিবাদে ইসরাইল থেকে তুরস্ক সমস্ত কূটনীতিকদের তেলআবিব থেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং ইসরাইল ও তুরস্কের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন হয়ে যায়। চার বছর পরে অর্থাৎ ২০২২ সালে, তুরস্ক আবারও ইসরাইলে সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের  পদক্ষেপ নেয়। ইসরাইলের প্রেসিডেন্টের আঙ্কারা সফরের পর ইসরাইলে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়ে। 

এতে কোন সন্দেহ নেই যে কিছু মুসলিম দেশের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং ইসরাইলের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার কারণে ইসরাইল আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ থেকে অন্য মুসলিম সরকারগুলোর এটা বোঝা উচিত যে, ইসরাইলি কর্মকর্তারা আসলে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও চাপ বাড়াতে মুসলিম সরকারগুলোর সাথে যেকোনো ধরনের সুসম্পর্কে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তাই আরব দেশ ও তুরস্কের উচিত এখনই ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা।  

ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে তুরস্ক সরকারের নীতির একটি দুঃখজনক দিক হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ ক্ষেত্রে আঙ্কারার দ্বিমুখী অবস্থান। ড্যাভোস সম্মেলনে এরদোগান ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমোন পেরেযের সাথে মৌখিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন এবং ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি তেলআবিব থেকে তুর্কি রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা ২০২০ সাল থেকে দেখতে পাচ্ছে আরব সরকারগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে এবং সেইসাথে তুরস্কও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা ২০২১ সালে ইসরাইলের সালে সাইফ আল-কুদস যুদ্ধ এবং এরপর দুই দিন এবং তিন দিনের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে। এসব যুদ্ধে তুরস্ক ও আরব দেশগুলো চাইলে ফিলিস্তিনকে সহযোগিতা করতে পারতো। তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি লোক দেখানো সমর্থন দেয়া থেকে বেরিয়ে এসে সহজে ইসরাইলকে চাপে ফেলতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেনি।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব দেশ ও তুরস্কের আরেকটি যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তা হল, তারা এটা প্রমাণ করতে পারে যে ইসরাইলের কোনো বৈধতা নেই। তেল আবিব নিজেও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অঙ্গনে বৈধতার সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছে। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনেক দেশ ইসরাইলের সাথে খেলা বর্জন করায় ইসরাইল আতঙ্কিত।

বাস্তবতা হলো, ইসরাইল আবারো গাজায় যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছে। যেহেতু পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসরাইলের পাশে রয়েছে তাই আরব সরকারগুলো ও তুরস্কেরও উচিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দিয়ে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসা। যদিও তুরস্কসহ আরব দেশগুলোর কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে মৌখিক সমর্থন দিয়েছে তা প্রশংসাযোগ্য কিন্তু ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে ফিলিস্তিনিদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী হবে এবং ইসরাইল গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য হবে।#  

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

 

 

 

ট্যাগ