নভেম্বর ২০, ২০২৩ ২০:৫৬ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের পক্ষে অদৃশ্য বা ঐশী সাহায্য সম্পর্ক আলোচনা করেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে মহানবী (সা.) এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা সম্পর্কে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরাকি বাথ সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানি সৈনিকদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান ও পরিপূর্ণ নির্ভরতা। ইরানি যোদ্ধারা দৃঢ়ভাবে একথা বিশ্বাস করতেন, তাদের এই ঈমানের কারণে ইরাকি বাহিনীর তুলনায় সামান্য সমরাস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে তারা একের পর এক অভিযানে জয়ী হয়েছেন। যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়াকেও তারা শাহাদাত এবং ঐশী সিদ্ধান্ত বলে মনে করতেন। তারা ওই যুদ্ধে শুধু ঐশী সাহায্যই পাননি বরং যতগুলো বিজয় অর্জন করেছেন তার প্রত্যেকটিকে তারা ঐশী উপহার বলে মনে করেছেন। ইরানি যোদ্ধারা বিশ্বাস করতেন, প্রচুর পরিমাণ সৈন্য ও সমরাস্ত্র যুদ্ধ জয়ের নিয়ামক শক্তি নয় বরং যুদ্ধে বিজয় আসে আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে ইরানি যোদ্ধারা খুব কমই কোনো অভিযানে বিজয় লাভের পর উল্লাস ও অহংকারে মেতে উঠতেন।

ইরানি যোদ্ধা ও কমান্ডারদের বহু বর্ণনায় এই বিষয়টি উঠে এসেছে। ‘১৭ আলী ইবনে আবি তালিব’ ব্রিগেডের কমান্ডার শহীদ মাহদি জেইনেদ্দিন মনে করতেন: “সৈন্য সংখ্যার প্রাচুর্য বা ঘাটতি যুদ্ধ জয়ের কারণ নয়, সৈন্যদের গুণগত মান ও সংখ্যাধিক্যও যুদ্ধে জয় এনে দিতে পারে না বরং যুদ্ধ জয়ের একমাত্র কারণ আল্লাহ তায়ালার সাহায্য।” ইরানের সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি এক সাক্ষাৎকারে বলেন: “পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে: আর তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুত রাখ শক্তি ও অশ্ব বাহিনী, আমরা এই নির্দেশ মেনে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি।  ইরাকি বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য যা কিছু করার চিন্তা মাথায় এসেছে তার সবই আমরা করেছি। সেইসঙ্গে আমরা কখনও একথা ভুলে যাইনি যে, এসব প্রস্তুতি নেওয়ার পর আমরা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছি। আমরা মনে করেছি, এখন আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারি এবং এই আঘাতে বিজয়ের জন্য ঐশী সাহায্য লাভ করতে পারি। ”

আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি সৈনিকেরা আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে জেনারেল শিরাজির এই বক্তব্যকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তারা আরো বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ওসিলা হিসেবে মহানবী (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের ভূমিকা রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসাকে মুসলমানদের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা শুরার ২৩ নম্বর আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে: বলুন, আমি আমার রিসালাতের বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে আত্মীয়তার বা আমার আহলে বাইতের প্রতি সৌহাদ্য ছাড়া অন্য কোন প্রতিদান চাই না।  এছাড়া, বহু হাদিসে আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসাকে ঈমানদারি এবং তাঁদের সঙ্গে শত্রুতাকে নিফাকের লক্ষণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

মহানবী (সা.) রিসালাতের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য নেতা ছিলেন। হুজুরে পাক (সা.) যেভাবে ধর্মীয় কর্তব্য পালন করেছেন মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে, হুবহু সেরকমভাবে নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা। অর্থাৎ, মুসলমানদেরকে আল্লাহর নির্দেশ তাঁর রাসূলের দেখিয়ে দেওয়া উপায়ে পালন করতে হবে। শিয়া আলেমদের মতে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর আহলে বাইতের পবিত্র সদস্যরা অনুসরণযোগ্য সেই নেতৃত্বের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। শিয়া মাজহাব অনুসারে, আল্লাহর নির্দেশে গাদিরে খোমে এই দায়িত্ব হযরত আলী (আ.)-এর কাছে এবং পরবর্তীতে আহলে বাইতের অন্যান্য ইমামের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে।

বিশ্বনবী (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলোতে পবিত্র কুরআন ও তাঁর আহলে বাইতকে মুসলমানদের জন্য দু’টি মূল্যবান বস্তু হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন। তিনি তাঁর আহলে বাইতকে পবিত্র কুরআনের মতো অনুসরণ করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গেছেন।  শিয়া মাজহাবের বিশ্বাসগত ভিত্তি হচ্ছে, এই পৃথিবী কখনও কোনো অবস্থায় ওলী বা পরিপূর্ণ মানববিহীন অবস্থায় থাকবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর ওফাতের পর হযরত আলী (আ.) ও ১১ ইমাম হচ্ছেন সেই পরিপূর্ণ মানব। শিয়া আলেমগণ মনে করেন, আল্লাহর এসব আউলিয়ার আধ্যাত্মিক শক্তি তাদের মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় না বরং মৃত্যুর পরও তা অব্যাহত থাকে। এ কারণে পার্থিব জীবনে আল্লাহ তায়ালার দয়ালাভ ও পরকালে শাফায়াত পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইমামদের ওপর তাওয়াসসুল করা যায় বা তাদেরকে মাধ্যম হিসেবে আহ্বান করা যেতে পারে।

ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি সৈনিকেরা ইমামদের প্রতি তাওয়াসসুল করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের প্রায় সবার ছিল অগাধ ভালোবাসা ও আনুগত্য। এই ভালোবাসার মাত্রা এতটা বেশি ছিল যে, ইরানি যোদ্ধারা যেন আহলে বাইতের ইমামদের জীবদ্দশায় তাদের আনন্দ ও কষ্টের ভাগিদার ছিলেন। ইরানি যোদ্ধারা যেন বদর, ওহুদ, খন্দক ও হুনায়েনের যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.)-এর সঙ্গী হয়েছিলেন। তারা যেন সিফফিন ও নাহরাওয়ানের যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)-এর সহচরে পরিণত হয়েছিলেন। ইরানি যোদ্ধারা কেমন যেন কারবালার ময়দানে উপস্থিত থেকে ইমাম হোসেইন (আ.) এর সঙ্গে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছিলেন এবং বিবি জয়নাবের সঙ্গে ইমাম শিবিরের জীবিত সদস্যদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অশ্রুসজল চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে আহলে বাইত আলাইহিমুস সালামের প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের আনুগত্যের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন ব্রিগেড ও অভিযানের নামকরণে। মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ, ইমাম আলী, ইমাম মাহদি, সামেনাল আয়েম্মে, হোসেইন বিন আলী এবং সারুল্লাহ হচ্ছে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানের পরিচালিত বিভিন্ন ছোট-বড় অভিযানের নাম। একদিকে, ইরাকের তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দাম ও তার অনুসারীরা ইসলামের শত্রু ছিল এবং আহলে বাইতের অনুসারী ও শিয়া আলেমদের হত্যা করত, তেমনি ইরানি যোদ্ধাদের অন্তর ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ ২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ