নভেম্বর ৩০, ২০২৩ ২০:৪৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইরানের নারী সমাজের যে চিত্র তুলে ধরা হয় তার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরানের নিরাপত্তা নিয়ে পাশ্চাত্যের প্রচারণা সম্পর্কে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

যেকোনো দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী তা দিয়ে ওই দেশের শক্তিমত্তা পরিমাপ করা যায়। ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান ও তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দেশটির নিরাপত্তার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।  

নিরাপত্তা শব্দটি শুনলে বিশ্বের যে কারো মনে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ই জেগে উঠবে। তবে নিরাপত্তার গুরুত্ব একেকজন একেকভাবে উপলব্ধি করে। সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও সুদানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর নাগরিকরা তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ দেশগুলোতে বসবাসকারী নাগরিকদের চেয়ে নিরাপত্তার গুরুত্ব অনেক বেশি উপলব্ধি করে। এক সময় বৈদেশিক শক্তির সামরিক আগ্রাসন থেকে একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার মধ্যেই ওই দেশের নিরাপত্তা সীমিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিদেশি শত্রুরা শুধুমাত্র সামরিক উপায়ে একটি দেশের নিরাপত্তাকে হুমকিগ্রস্ত করে না; বরং তারা তাদের টার্গেটে থাকা একটি দেশের প্রতিটি বিষয়কে নিরাপত্তাহীন করে তোলার চেষ্টা করে।  

খাদ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পরিবেশ থেকে শুরু করে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মতো বিষয়গুলো এখন আর বিদেশি শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ নয়।  একটি দেশের মানুষের জীবনের প্রতিটি বিষয়কে নিরাপত্তাহীন করে তোলার কাজে এখন গণমাধ্যমকে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গণমাধ্যম দিয়ে অনেক কম খরচে সামরিক আগ্রাসনের চেয়ে বেশি কার্যকরভাবে শত্রুকে ঘায়েল করছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। অবশ্য তাদের এই নব্য আগ্রাসন কেবল সেসব দেশে কাজ করছে যেসব দেশের মানুষ গণমাধ্যমের ছলচাতুরি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী তাকে বিবেচনায় না নিয়ে ওই দেশকে নিরাপদ ভাবা ঠিক নয়। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিবিএসে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’সহ দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ২০১৯ সালের পর থেকে নানা রকমের অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সংঘবদ্ধ অপরাধের দিক দিয়ে এই দেশটি শীর্ষে অবস্থান করছে। এসব খবর দেখলে যে কারো উচিত আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলো ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। কিন্তু বাস্তবে এসব দেশে বিদেশি নাগরিকদের ভ্রমণ করার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এর কারণ হচ্ছে, আমেরিকা ও ব্রিটেনের নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির এসব খবর তারা দায়সারাভাবে প্রচার করে ঠিকই কিন্তু হাজার হাজার প্রতারণামূলক খবরের ভিড়ে এসব খবর হারিয়ে যায়।

পক্ষান্তরে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো মাঝেমধ্যেই ইরান ভ্রমণের ব্যাপারে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সতর্ক করে দেয়।  মিথ্যা খবর তৈরি করা, কোনো ঘটনার অতিরঞ্জিত বিশ্লেষণ, বাস্তবতা উল্টো করে তুলে ধরা, ইরানের ছোট ছোট দুর্বলাগুলোকে বড় করে তুলে ধরা এবং ইরানের শক্তিমত্তার জায়গাগুলোকে উপেক্ষা করা হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর ইরান সংক্রান্ত খবরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এসব প্রচারণা উপেক্ষা করে যেসব বিদেশি পর্যটক ইরান ভ্রমণে আসেন তাদের চোখে প্রথমেই ধরা পড়ে ইরানের উন্নত মানের নিরাপত্তা পরিবেশ। একজন বিদেশি পর্যটক নিজের ইরান সফরের অভিজ্ঞতা এভাবে বর্ণনা করেন: “আমি এ পর্যন্ত ৪০টি দেশ সফর করলেও ইরানের মতো এত নিরাপত্তা আর কোথাও পাইনি। আর ইরানিদের আতিথেয়তা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে।”

একবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকে উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের উত্থানের কারণে বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় এই গোষ্ঠী ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন একথা স্বীকার করেছেন যে, আইএস বা দায়েশকে আমেরিকাই তৈরি করেছে। এই গোষ্ঠী ২০১‌৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে নানা কায়দায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে অন্তত ৩০০ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। এ সময়ে তাদের হাতে আহত হয় আরো প্রায় ৯০০ মানুষ। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার শহরে দায়েশের হামলায় ২৩ জন এবং ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ১৩০ জন নিহত হয়।  ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ তার দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হন। ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে ছয় থেকে সাত হাজার সেনা মোতায়েন করতে হয়।

ইরানেও ওই দিনগুলোতে উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের একটি হামলা হয়েছিল। তবে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী এতটা শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে যে, মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে সকল সন্ত্রাসী নিহত হয়। ওই হামলায় ১৭ জন নিহত নিহত ও অপর ৪৫ জন আহত হন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রে অনেক বড় সাফল্য লাভ করেছে। জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস ইরানের হাতে যে মার খেয়েছে তাতেই তার কোমর ভেঙে গেছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর ভাষায় এই জঙ্গি গোষ্ঠী ছিল সামান্য সময়ের জন্য জ্বলে ওঠা একটি আতশ বাজি মাত্র। শহীদ লে. জেনারেল কাসেম সোলাইমানির নেতৃত্বে ইরানের কুদস ফোর্স  ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশকে চরম পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছে।

আইএস বহুবার ইরাক থেকে ইরানে ঢুকে পড়ার কিংবা ইরানের বিভিন্ন শহরে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ইরানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেসব হামলা বাস্তবায়নের আগেই ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।  আইএস নির্মূল হয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের শেষদিকে ইরানে বিদেশি মদদে চাপিয়ে দেওয়া সহিংসতার মধ্যে সিরাজের একটি মাজারে হামলা চালায় এই জঙ্গি গোষ্ঠী। তবে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই মাজারে হানা দেয় এবং হামলাকারী সন্ত্রাসীর নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে ওই হামলা শেষ। কিন্তু ওই হামলা থেকে ইরান যে শিক্ষা নিয়েছে তা হলো- এই জাতি যদি নিজের ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখতে না পারে এবং নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নে সামান্যতম আপোষও করে তাহলে শত্রুরা সে সুযোগ নিতে কার্পণ্য করবে না।

এদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো মাঝেমধ্যেই বিশ্লেষকদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে এবং সেখানে ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক হামলা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে। তাদের আলোচনা শুনলে মনে হয় অচিরেই পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরানে হামলা চালাবে। তবে নিরপেক্ষ ভাষ্যকাররা মনে করেন, ইরানে হামলা চালাতে নয় বরং এদেশের মানুষের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করা হচ্ছে এ ধরনের প্রচারণার প্রধান উদ্দেশ্য। তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এসব গোলটেবিল বৈঠকের বেতনভুক্ত বিশ্লেষকরা একটি বিষয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়; আর তা হচ্ছে, ইরান তার জল, স্থল ও আকাশসীমাকে সামরিক শক্তিমত্তা দিয়েই সুরক্ষা করতে পেরেছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ