ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩ ১৪:৫৪ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা ওমর খৈয়ামের জন্মস্থান নিশাপুর শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং এই শহরের নানা উত্থান-পতনের ঘটনার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকেও আমরা এ সম্পর্কিত আলোচনা অব্যাহত রাখবো।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা ইসলাম আগমনের পর ইরানের নিশাপুর অঞ্চলে তাহেরিয়ানদের শাসন এবং এরপর ইয়াকুব ইবনে আল-লাইস আল-সাফারি বংশের শাসনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এরপর আসে গাজনাভিয়ানদের শাসনের পালা। গাজনাভিয়ানদের সময় নিশাপুরের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অটুট ছিল এবং সেখানে দৃষ্টিনন্দন বাগান ছিল। আবুল-ফজল বায়হাকি ছিলেন একজন ইরানি ঐতিহাসিক যিনি গাজনাভিয়ানদের আদালতের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি খোরাসান, গজনী ও হেরাতের সে সময়ের সুন্দর সুন্দর বাগান সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। আবুল-ফজল বায়হাকি তাঁর বইয়ে যে বাগানের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটি হল নিশাপুরের 'শাদিয়াখ' বাগান। 'শাদিয়াখ' নিশাপুরের সবচেয়ে সুন্দর ও প্রসিদ্ধ একটি বাগান বা পার্ক এলাকা যাকিনা এই শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ছিল, যেখানে একটি সুন্দর প্রাসাদও ছিল। এই বাগানটি গাজনাভিয়ান রাজাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা হিসাবে পরিচিত ছিল।

কিন্তু গাজনাভি মাসউদের শাসনামলে নিশাপুরের জনগণের জীবনে নেমে আসে কঠিন দুরবস্থা। শাসক শ্রেণীর নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তা তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সেসময় ইরানের সেলজুকিয়ান শাসকরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে সহজেই নিশাপুর দখল করে নেয়। সেলজুকিয়ানদের শাসনামলে ওমর খৈয়াম নিশাপুরে বড় হন।

ইরানিরা সবসময়ই গণিত, চিকিৎসা ও সাহিত্যের মতো বিভিন্ন বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি ও বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জনে ইরানিদের ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রিস্টীয় ১১ শতকে বসবাসকারী বিশিষ্ট ইরানি ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন হলেন 'হাকিম ওমর খৈয়াম'। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সাহিত্য অঙ্গনে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে এমন খুব কম লোকই আছেন যারা বিশ্বখ্যাত এই ইরানি মনীষীকে চেনেন না। যেহেতু সেলজুকিয়ানদের আমলে ওমর খৈয়াম নিশাপুরে বড় হন তাই খৈয়াম সম্পর্কে কিছু বলার আগে সেলজুক আমল থেকে এখন পর্যন্ত এই শহরের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।

সেলজুক শাসনামলের একটি চিত্র

সেলজুক আমলে বিশেষ করে মালিক শাহের শাসনামলে, নিশাপুর এমনভাবে বিকাশ লাভ করে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলোর একটিতে পরিণত হয়।

এই সময়ে অর্থাৎ ১০৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরে প্রথম 'নিজামিয়া' শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে যা আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সমান মর্যাদাপূর্ণ ছিল। ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাত ইতালিতে ইউনিভার্সিটি অফ বোলোগনা প্রতিষ্ঠার ৩১ বছর আগে এবং ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছর আগে, ইরানের নিশাপুরে 'নিজামিয়া' শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এছাড়াও, সেলজুক আমলে নিশাপুর শহরে ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

সেলজুকরা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইরান শাসন করেছিল এবং 'হাকিম ওমর খৈয়াম' ঠিক ওই সময়টিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমরা এই ধারাবাহিকের অন্য কোনো পর্বে সেলজুক রাজবংশ সম্পর্কে কথা বলব। তবে, নিশাপুর শহরের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আরেকটু এগিয়ে এসে সেলজুকের পর খাওয়ারেজম শাহিয়ানদের অর্থাৎ আনুশতেগিন রাজবংশ নিয়ে কথা না বললেই নয়।

অবশ্য, আমরা যখন ক্ষমতার পালাবদল অর্থাৎ এক রাজবংশের হাত থেকে আরেক রাজবংশের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলি, তখন আমাদের মনে রাখা উচিত যে এক রাজবংশ থেকে অন্য রাজবংশের কাছে ক্ষমতা রাতারাতি চলে যায় না এবং তার আগে এমন অনেক ঘটনা ঘটে ও পরিস্থিতি তৈরি হয় যার ফলে একটি রাজবংশ ধ্বংস হয়ে যায় এবং অন্য রাজবংশের হাতে ক্ষমতা চলে যায়।  শুরুতে খাওয়ারেজম শাহিয়ানরা ছিল সেলজুক শাসকদের পুতুল সরকার যারা ইরানের একটি অংশ শাসন করতো, কিন্তু ধীরে ধীরে খাওয়ারেজম শাহিয়ানরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং আলাদা একটি রাজ্য গঠন করে। খাওয়ারেজম শাহিয়ান রাজবংশের শাসনকালে নিশাপুরের উন্নতি ও সমৃদ্ধি তাদের কাছে অতটা গুরুত্ব পায়নি। বলা যায়, তাদের সময়কাল ছিল এই পুরানো শহরের পতনের সূচনাপর্ব, কিন্তু চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হানাদার মঙ্গোলদের মাধ্যমে। এরপর সপ্তম শতাব্দী অর্থাৎ ১৩ শ' খ্রিস্টাব্দে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে নিশাপুর কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

নিশাপুরে ওমর খৈয়ামের সমাধিস্তম্ভ

মঙ্গোলরা ১২২১ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুর অবরোধ করলে নিশাপুরের জনগণের প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

ইতিহাসে আছে, মঙ্গোলদের অবরোধের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে হানাদার চেঙ্গিস খানের জামাতা নিহত হয়। তাই, যখন মঙ্গোল বাহিনী শহর দখল করে নেয় তখন তারা প্রতিশোধ হিসাবে নিশাপুরে এক ভয়ানক গণহত্যা চালায়। তারা সমস্ত লোককে ধরে শহরের বাইরে নিয়ে যায় এবং কয়েকজন কারিগর ছাড়া বাকিদের হত্যা করে।  সেইফি হোরাভির উদ্ধৃতিসহ আরো কিছু সূত্র ওই হামলায় নিহতের সংখ্যা ১৭ লাখ ৪৭ হাজার বলে উল্লেখ করেছে। এই সংখ্যাটি সেই সময়ে নিশাপুর শহরের সমৃদ্ধি ও বিশালত্ব প্রমাণ করে। কিন্তু মঙ্গোলদের বর্বরতার পর, নিশাপুর কখনও তার অতীত গৌরব ফিরে পায়নি। অর্থাৎ ইরানের সংস্কৃতি, জনগণ এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের ওপর মঙ্গোলরা যে নিষ্ঠুর আঘাত হেনেছিল তা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। মঙ্গোলরা ইরানের যেখানেই গেছে সেখানেই নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। মঙ্গোলদের আক্রমণের পর নিশাপুর শহরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। হতাশাগ্রস্ত এই শহরের বেঁচে থাকা লোকেরা কয়েক বছর পর্যন্ত কৃষিকাজও করতে পারেনি।

 কিন্তু একের পর এক দুর্ভাগ্য নিশাপুরের জনগণের পিছু ছাড়েনি। খ্রিস্টীয় ১৩ শতকে এই শহরে একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। এতে নিশাপুর আগের চেয়ে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং অঞ্চলটির সমৃদ্ধি আর কখনো ফিরে আসেনি। মঙ্গোল প্রজন্মের উত্তরাধিকার ইলখানিয়ান রাজবংশের শাসনামলে নিশাপুর শহরটি পুননির্মিত হয়েছিল। ইলখানিয়ানরা খ্রিস্টীয় ১২৫৮ থেকে ১৩৫৬ সাল পর্যন্ত শাসন করে।

হালাকু খানের পুত্র আবাকা খান নিশাপুর পুনর্নিমাণের নির্দেশ দেন। নতুন শহরটি দ্রুত বিকাশ এবং বিস্তৃতি লাভ করে। ১৩০৪ থেকে ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দের বিখ্যাত মুসলিম ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা তার বইয়ে উর্বরতা এবং প্রচুর ফল-মূল উৎপাদনের কারণে এই শহরটিকে 'ছোট দামেস্ক' হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এরপর, তৈমুরিয়ানদের রাজত্বকালে নিশাপুরের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং এই রাজবংশ হেরাত শহরকে রাজধানী হিসাবে বেছে নেয়। তাদের কাছে নিশাপুর ছাড়া অন্য শহরের গুরুত্ব বা মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে নিশাপুর আর তার ঐতিহ্য ফিরে পায়নি। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ