ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযানের ফলাফল-(পর্ব-৫)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আমেরিকা কিভাবে ইসরাইলকে সহযোগিতা করেছে সে সম্পর্কে কথা বলেছি। আজো আমরা গাজা যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা অব্যাহত রাখবো।
এর আগে গত চারটি পর্বের আলোচনায় আমরা হামাস ও ইসরাইলের ওপর গাজা যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে আমরা ইসরাইলের অর্থনীতিতে গাজা যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এবং ইহুদিদের গণহারে ইসরাইল ত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা কবো।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, হামাসের আল-আকসা তুফান অভিযানে ইসরাইল বিশাল ও নজিরবিহীন আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সম্মুখীন হয়েছে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ এই দুইভাবে ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতিগুলো এই যুদ্ধের খরচের সাথে সম্পর্কিত যা ইসরাইল সরকার বহন করে। আর পরোক্ষ ক্ষতিগুলো হল সেইসব ক্ষতি যা এই যুদ্ধের কারণে ইসরাইলের বিভিন্ন কোম্পানি ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে, যার পরিমাণ কোটি কোটি ডলার। ইসরাইলি দৈনিক ইয়াদিউত অহারনুত জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধের কারণে ইসরাইলের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে গত মাসে প্রায় ৬৭৫০ কোটি ডলার গাজা যুদ্ধে খরচ হয়েছে। দৈনিকটি আরো জানিয়েছে এই পরিমাণ অর্থ ইসরাইলের বার্ষিক উৎপাদিত আয়ের ১৫ শতাংশ।
ইসরাইলের চ্যানেল-টুয়েলভ টেলিভিশন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রীসভার কর্মকর্তাদের সাথে তিন ঘণ্টা বৈঠক করেছে যেখানে গাজা যুদ্ধের ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে গাজা যুদ্ধের পেছনে প্রতিদিন প্রায় ১০০ কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে। কিছু সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এই টিভি চ্যানেল আরো জানিয়েছে, ইসরাইলকে দেয়া মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০০ কোটি ডলার, যা অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঘোষণা করেছে, জনবলের অভাবের কারণে এই সরকারের যে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে তার পরিমাণ প্রতি সপ্তাহে ২৩০ কোটি 'শেকেল'। শেকেল হচ্ছে ইসরাইলের জাতীয় মুদ্রার নাম। যুদ্ধের কারণে ইসরাইলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, গাজা ও লেবানন সীমান্ত থেকে প্রায় এক লাখ ৪৪ হাজার কর্মীকে অন্যত্র স্থানান্তর করা এবং রিজার্ভ সৈন্য তলব করার কারণে এসব বাড়তি ব্যয় হয়েছে।
ইসরাইলের শ্রমবিভাগ থেকে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর অক্টোবরে বেকার মানুষের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। হিব্রু ভাষায় ইসরাইলের অর্থনৈতিক সংবাদপত্র 'গ্লোবস' সরকারের দেয়া মাসিক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেছে, ইসরাইলের ৭০ হাজার লোক বেকার হয়ে পড়েছে এবং এর পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় ৪৬০ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বরে বেকারত্বের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২৫০ জন। এর মধ্যে ৪২ হাজার ৪০০ ইসরাইলি কর্মী বিনা বেতনে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে রয়েছে। এ ছাড়া, ইসরাইল সরকার যুদ্ধের জন্য রিজার্ভ বাহিনীর চার লাখ সদস্যের মধ্যে তিন লাখ ৬০ হাজার সেনাকে তলব করেছে। ফলে এই পরিমাণ বাহিনী নিয়োগ ও সংগঠিত করার জন্য একটি বিশাল খরচের প্রয়োজন। অন্যদিকে, কলকারখানা, বিভিন্ন অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাকেন্দ্র থেকে বিপুল সংখ্যক জনবল বেরিয়ে যাওয়ায় পরোক্ষভাবে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া, শ্রমশক্তির প্রায় ৮ শতাংশকে সেনাবাহিনীতে জরুরী সেবাদানের জন্য ডাকা হয়েছে, যেকারণে ইসরাইলে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, হাইফা বন্দরও প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম এবং সেখানে কোন বিদেশী জাহাজ প্রবেশ করছে না।
অন্যদিকে, ইসরাইল কর্তৃপক্ষ উত্তরাঞ্চলীয় লেবানন সীমান্তের বসতি এলাকা থেকে প্রায় আড়াই লাখ ইসরাইলি নাগরিককে দক্ষিণের ইলাত এলাকায় স্থানান্তর করেছে। গাজা উপত্যকা সংলগ্ন ৫৫টি ইহুদি বসতিও খালি করা হয়েছে যেখানে প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দা ছিল। ফলে, ইসরাইলের অভ্যন্তরে অন্তত তিন লাখ মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে, যার জন্য সরকারকে কোটি কোটি ডলার খরচ করতে হয়েছে। হামাসের রকেটের আওতাভুক্ত এলাকায় বহু দোকানপাট, চিকিৎসাকেন্দ্র, স্কুল, পরিবহন পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, আর্থিক পরামর্শকারী সংস্থা "লিডার ক্যাপিটাল মার্কেটস" যার সদর দপ্তর তেল আবিবে অবস্থিত, তারা অনুমান করছে যে ২০২৩-২০২৪ বছরের জন্য এই যুদ্ধের মোট খরচ হবে প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সমান। এই সংস্থার মতে, ইসরাইলকে সম্ভবত মোট খরচের দুই-তৃতীয়াংশ বহন করতে হবে এবং বাকিটা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, গাজা যুদ্ধের ফলে নিরাপত্তাহীনতার কারণে ইসরাইলে দেশি-বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
হামাসের সাথে ইসরাইলের সংঘাত শুরুর পর অধিকৃত এলাকা থেকে ইহুদিদের ইসরাইল ত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে। অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল থেকে ইহুদি অভিবাসীদের পলায়নের ঘটনা যদিও অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল কিন্তু সম্প্রতি গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইহুদিদের ইসরাইল ত্যাগের ঘটনা বহুগুণে বেড়ে গেছে। গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে ইসরাইলি আগ্রাসন দুই মাস পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে হামাসও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানোয় চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে অবৈধ ইহুদি অভিবাসীদের ইসরাইল ত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে। ইসরাইলের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, হামাসের আল-আকসা তুফান অভিযান শুরুর পর দখলীকৃত এলাকা ছেড়ে যাওয়া ইহুদিদের সংখ্যা পাঁচ লাখে পৌঁছেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যারা ইসরাইল ছেড়ে চলে গেছে তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। পর্তুগালের অভিবাসন দফতর জানিয়েছে, এই বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ইসরাইলি পর্তুগালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছে। পর্তুগালে বিদেশে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে ইসরাইলিরা।
ফিলিস্তিনিদের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিরাপত্তাহীনতার কারণে ইসরাইলিরা অন্যত্র চলে যেতে আরো বেশি উদগ্রীব হয়ে আছে। ইসরাইলি নাগরিকরা যে শব্দগুলো গুগলে সবচেয়ে বেশি সার্চ করে তা হলো "ইসরাইল থেকে প্রস্থান করা" এবং এর সাথে সম্পর্কিত উপায়গুলোর অনুসন্ধান করছে তারা। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অভিবাসনের পাশাপাশি এসব ইহুদি অভিবাসীরা অন্য দেশের নাগরিকত্বও পেতে চায়। এসব ইহুদি অভিবাসীরা তাদের গন্তব্য হিসাবে ইউরোপীয় দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ইসরাইলের এক পরিসংখ্যান থেকে বলা হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে পর্তুগাল, জার্মানি ও পোল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেতে ইসরাইলিরা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করছে।# (সমাপ্ত)
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।