ভার্চুয়াল জগত ও বাস্তবতা (পর্ব-১)
'ভার্চুয়াল জগত ও বাস্তবতা' শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে আমরা ভার্চুয়াল জগতের নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলব এবং কীভাবে এই জগতের সঠিক ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করব। সবচেয়ে বড় কথা আমরা হচ্ছি এমন একটি প্রজন্ম যাদেরকে প্রথমবারের মতো তাদের সন্তানকে ইন্টারনেট ও ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে একসাথে প্রতিপালন করতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে আমাদের প্রিয় সন্তানদেরকে এই জগতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করব? আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের চেয়ে আমাদের কাছে আর কোনো কিছু বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমাদেরকে এ বিষয়ে
'ভার্চুয়াল জগত ও বাস্তবতা' শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে আমরা ভার্চুয়াল জগতের নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলব এবং কীভাবে এই জগতের সঠিক ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করব। সবচেয়ে বড় কথা আমরা হচ্ছি এমন একটি প্রজন্ম যাদেরকে প্রথমবারের মতো তাদের সন্তানকে ইন্টারনেট ও ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে একসাথে প্রতিপালন করতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে আমাদের প্রিয় সন্তানদেরকে এই জগতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করব? আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের চেয়ে আমাদের কাছে আর কোনো কিছু বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমাদেরকে এ বিষয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় বুৎপত্তি অর্জন করতে হবে।
শ্রোতাবন্ধুরা, যে যন্ত্রসঙ্গীতটি শুনছেন সেটি কি আপনাদের পরিচিত নয়? (পাঠক থামবেন, মিউজিক বেড়ে যাবে ২ থেকে ৩ সেকেন্ড) জি ঠিক ধরেছেন। আমরা সবাই পিনোকিওকে চিনি। কাঠের তৈরি একটি সহজ-সরল পুতুল যার আকাঙ্ক্ষা ছিল মানুষ হওয়ার। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করার জন্য যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না। যেকোনো অবিশ্বাস্য কথাও সে বিশ্বাস করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। আমার মন হয়, বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে পিনোকিওর মতো মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। আমার কথায় অবাক হচ্ছেন? এখনই বিষয়টি খুলে বলছি।
আপনার কি জানা আছে ডোপামিন কাকে বলে? নাহ, ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাটির প্রয়োজন নেই। আমিই বলে দিচ্ছি। ডোপামিন আপনাকে আনন্দ, তৃপ্তি এবং অনুপ্রেরণার অনুভূতি দিতে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কাজ করে। স্মৃতি, মেজাজ, ঘুম, শেখা, একাগ্রতা, নড়াচড়া এবং শরীরের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণে ডোপামিনের ভূমিকা রয়েছে। আনন্দ অনুভূতি তৈরিতে ডোপামিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে মানুষের অন্তরে উচ্ছ্বাস ভাব তৈরি হয়। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য ডোপামিন আমাদের মধ্যে সদিচ্ছা জাগ্রত করে এবং লক্ষ্যে পৌঁছে গেলে আমাদেরকে স্বস্তি ও আনন্দের অনুভূতি দেয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি প্রতিহত করার জন্য আমাদেরকে নিজেদের জন্য নতুন নতুন লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং বড় লক্ষ্যগুলোকে ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করে ফেলতে হবে।
এখন কি আপনি ডোপামিন ও পিনোকিওর মধ্যে কোনো সম্পর্ক খুঁজে পেলেন? না পেয়ে থাকলে আমি বুঝিয়ে বলছি। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, একবার পিনোকিও খেলনার জগতে যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। সে এমন একটি জগতে যেতে চেয়েছিল যেখানে কোনো স্কুল বা লেখাপড়া নেই। যেখানে শিশুরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু খেলাধুলায় মেতে থাকে। আমার মনে হয়, আমাদের গল্পের এই পিনোকিও ডোপামিনের সন্ধানে ছিল। সে ওই জগতে গিয়ে ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করে প্রতিদিন নিজের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। সে যেহেতু জানত যে, এ কাজ করার জন্য তার পক্ষে মানুষ হওয়া সম্ভব নয় তাই সে প্রচণ্ড হতাশায় ভুগত এবং সেই হতাশা থেকেই সে নিজের ডোপামিনের পরিমাণ উচ্চ মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এ কারণে সে নিজের জন্য ছোট ছোট ও বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিল। কিন্তু সে একথা চিন্তা করে দেখেনি যে, এসব ছোট ছোট লক্ষ্য কি তাকে সেই কাঙ্ক্ষিত বড় লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবে? নাকি তাকে অন্য কোনো লক্ষ্যে নিয়ে যাবে কিংবা আদৌ কোনো লক্ষ্যেই পৌঁছাতে পারবে না? কিন্তু পিনোকিওর জন্য এসব আসলে কোনো বিষয়ই ছিল না, সে শুধু আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চেয়েছিল।
আমরা এখন যে যুগে বাস করছি সে যুগের বহু মানুষ এখন পিনোকিওর মতো হয়ে গেছে। এখানে ভার্চুয়াল জগত ও সামাজিক মাধ্যমগুলো পিনোকিওর সেই খেলনার জগতের ভূমিকা পালন করছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সামাজিক মাধ্যমগুলোর উদ্ভাবক ও প্রস্তুতকারকরা কখনওই আমাদের মতো এত বেশি সময় সামাজিক মাধ্যমে সময় কাটান না। আপনাদের যদি মনে থাকে, পিনোকিওর খেলনার জগতের সেই কোচওয়ানও কখনও খেলনা নিয়ে খেলত না। কি অদ্ভুত মিল, তাই না?
ফেসবুকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাগারবার্গ তার পেজ থেকে কমেন্ট ও স্প্যামগুলো ডিলিট করার জন্য ১২ জনের একটি পর্যবেক্ষণ টিম তৈরি করেছেন। এই কোম্পানির কোনো একজন পরিচালক ফেসবুকে নিয়মিত ঢোকেন না। আপনি কি তাদেরকে আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে আনতে পারবন? পারবেন না। তারা খুব কমই তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট দেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখেন এবং বন্ধুদের তালিকাও প্রকাশ করেন না। এক্স বা সদ্য বিলুপ্ত টুইটারের ফাইনান্স সেকশনের পরিচালক নেড সিগাল টুইটারে খুবই কম সময় দেন। তিনি ছয় বছর টুইটারে কাজ করেছেন কিন্তু মাসে সর্বোচ্চ দুইবার টুইট করেছেন। টুইটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক প্যাট্রিক ডোর্সি অন্যদের তুলনায় সামাজিক মাধ্যমে বেশি সময় থাকেন। তিনি টুইটার প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় ২৩ হাজার টুইট করেছেন। তবে যারা নিয়মিত টুইট করেন এই সংখ্যা তাদের টুইটের অর্ধেকেরও কম। প্রকৃতপক্ষে তিনি মাঝেমধ্যে টুইটার পেজে প্রবেশ করেন।
ফেসবুকের প্রথম পরিচালক শন পার্কার ২০১৭ সালের অক্টোবরে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বলেন, ভার্চুয়াল জগতের নির্মাতাদের প্রধান প্রশ্ন ছিল এই যে, কীভাবে সুকৌশলে মানুষের সবচেয়ে বেশি সময় ও মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। পার্কার একটি সত্য স্বীকার করে বলেন, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মাঝেমধ্যে আপনাদেরকে কিছু ডোপামিন দেওয়া হয়। যেমন ধরুন, আপনি নিজের একটি ছবি আপলোড করলেন। এখন আপনি দেখতে চান যে, আপনার বন্ধুদের মধ্যে ঠিক কে কে আপনার ছবিতে লাইক দিল কিংবা কমেন্ট করল। কী কমেন্ট করল সেটিও কিন্তু আপনার দৃষ্টি এড়ায় না। যেকোনো পোস্টে এভাবে বেশি বেশি লাইক ও কমেন্ট পাওয়ার জন্য এরপর আপনি নিজের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট আপলোড করতে থাকেন। এটাই বাস্তবতা নয় কি?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের লাইক ও ডোপামিনের সম্পর্ক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বাস্তবিক কোনো দেখা-সাক্ষাৎ ছাড়াই গড়ে ওঠে। ফলে ভার্চুয়াল জগতে আমাদের মধ্যে এখন লাইক ও কমেন্টের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যে সম্পর্কের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই।
বিশ্বব্যাপী শুরু থেকেই ডোপামিনসমৃদ্ধ ওষুধের অপব্যবহার হয়ে আসছে। ‘ওষুধ’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের কল্পনার জগতে কোনো ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা সিরাপের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে এভাবে দেখতে রাজি নন। তারা মনে করেন, নিজের মধ্যে প্রয়োজনীয় আনন্দ অনুভূতি সৃষ্টি করা মানেই ডোপানিমসমৃদ্ধ ওষুধ সেবন করা।
যাই হোক, আমাদের যে ডোপামিনের প্রয়োজন রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এটি আমরা কীভাবে অর্জন করব সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডোপামিনসমৃদ্ধ ওষুধ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে তা উপকার বয়ে আনবে। ভার্চুয়াল জগতও আমাদের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত উপকার বয়ে আনবে যতক্ষণ তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকবে। কোনো অবস্থাতেই আমাদের নিয়ন্ত্রণ ভার্চুয়াল জগতের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কীভাবে আমরা ভার্চুয়াল জগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তা নিয়েই আমরা এই ধারাবাহিকে আলোচনা করব। আশা করি সবগুলো পর্বে আপনাদের সঙ্গ পাবো। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এমএআর/৩