আজারবাইজান প্রদেশ: কান্দাভন গ্রাম
দেখবো ঘুরে ইরান এবার’ অনুষ্ঠানের আজকের আয়োজন থাকছে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের প্রাকৃতিক কিছু সৌন্দর্যকে ঘিরে। ঐতিহাসিক নিদর্শনের বাইরেও এই প্রদেশে রয়েছে প্রকৃতিরাজ্যে ভ্রমণের অনন্য সুযোগ। ইরানের বিশাল বিস্তৃত ভূখণ্ডের এই অংশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
গ্রীষ্ম এবং বসন্ত ঋতুতে কেউ যদি এই প্রদেশ ভ্রমণে যান তাহলে আপনার মন তো প্রশান্ত হবেই, এখানকার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের মায়াবি সৌন্দর্যে আপনার আত্মাও হবে প্রফুল্ল। নিশ্চয়ই যেতে ইচ্ছে করছে। চলুন তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি চলে যাওয়া যাক। পর্বত-বধূ! কেমন চমৎকার একটা ব্যাপার, তাই না! কিন্তু পর্বত তো বিয়ে করে না, তাহলে বধূ হলো কী করে! হ্যাঁ, বধূ এখানে সৌন্দর্যের রূপক হিসেবে এসেছে। ইরানের মধ্যে যতো পাহাড় পর্বত রয়েছে তার মধ্যে সাহান্দকূহ দেখতে সবচেয়ে সুন্দর। আর বধূরাও যেহেতু বিয়ের দিন সাঁঝের কোণে সেজেগুজে পরম সুন্দরী হয়ে ওঠেন সহেতু ইরানের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী পর্বতটিকেও সেই নববধূর সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সাহান্দের পাদদেশ জুড়ে রয়েছে অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি। বিশেষ করে গ্রীষ্ম এবং বসন্ত ঋতুতে সাহান্দ এলাকার যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তা এককথায় চোখ জুড়ানো। এ সময়টাতে প্রকৃতি ভ্রমণেচ্ছুদের আগমনে তাই এই এলাকাটি থাকে মুখরিত এবং প্রাণবন্ত। সাহান্দের চূড়ায় রয়েছে স্কি খেলার সুযোগ। তাছাড়া এখানে খনিজ জল বা মিনারেল ওয়াটারের সহজপ্রাপ্যতাও সাহান্দের আলাদা একটি আকর্ষণ। এ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি আকর্ষণ হলো ‘কান্দাভন’ গ্রাম।
কান্দাভন গ্রামটি সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাব্রিয শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণ-পশ্চিমে সাহান্দ পর্বতের উপত্যকায় গ্রামটি অবস্থিত। নিরন্তর সবুজে ভরা এই উপত্যকাটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। নদীটি অতিক্রম করে গেলেই পড়বে সাহান্দ পার্বত্য অঞ্চল। সেখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক কান্দাভন গ্রামটি। এই গ্রামের ঘরগুলোর স্থাপত্যশৈলীও একেবারেই অন্যরকম। এইসব ঘর নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে লাভা থেকে সৃষ্ট এক ধরনের পাথর। এখানকার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে লাভা উদগীরণ হয়েছে, কালক্রমে সেগুলো ঠাণ্ডা হয়ে জমে গিয়ে শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে। সেগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে কান্দাভন পার্বত্য পল্লীর ঘরবাড়ি তৈরির কাজে। মনে করা হচ্ছে যে, আনুমানিক সাত শ’ বছর আগে মোঙ্গলদের পাশবিক আক্রমণের সময় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে লোকজন শেষ পর্যন্ত এ এলাকাটিকেই বেছে নিয়েছিল।

পৃথিবীর প্রস্তরময় বিখ্যাত তিনটি গ্রামের একটি হলো কান্দাভন। প্রাচীন রীতিতে নির্মিত এখানকার ঘরগুলোতে জনগণের বসবাসের বিষয়টিও ব্যতিক্রমধর্মী একটি ব্যাপার। কেননা বিশ্বের প্রস্তরময় বাকি যে দুটি গ্রাম আমেরিকা এবং তুরস্কে অবস্থিত, সেইসব গ্রামে কোনো লোকজন বাস করে না, ফলে দর্শনার্থীগণ শূন্য ঘর ঐতিহাসিক স্মৃতি হিসেবে উপভোগ করে। কিন্তু ইরানের এই কান্দাভনে রয়েছে প্রাণের আমেজ। বিশেষজ্ঞমহল মনে করছেন এই গ্রামটি ইসলাম-পূর্ব কালে গড়ে উঠেছে। উঁচু উঁচু এই টিলাগুলোর বুক বিদীর্ণ করে তৈরি করা হয়েছে রুম, স্টোর রুম ইত্যাদি। এগুলো সত্যিই দেখার মতো। এ কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থার উপদেষ্টাগণ কান্দাভনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শনের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
কান্দাভন পল্লীতে দেখার মতো ঐতিহ্যবহুল নিদর্শনের মধ্যে আছে মসজিদ, হাম্মাম, মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ ধরনের যাঁতাকল যা পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে এক ধরনের ঘূর্ণায়মান চাকার সাহায্যে চলে। যে টিলাগুলোর বুক বিদীর্ণ করে ঘর বা বাসযোগ্য রুম তৈরি করা হয়েছে স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে ‘কারা’ন’ বলা হয়। যেই কারা’নে মসজিদটি অবস্থিত সেই কারা’নটি এই গ্রামের সবচেয়ে বড়ো বলে মনে করা হয়। কারা’নের ভেতরে যতোই উপরের দিকে যাওয়া যায়, ততোই সরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া গেলে অনেকটা টোপরের মতো মনে হতো। তবে এই গ্রামের অন্যান্য ঘরগুলো একটু অন্যরকম অর্থাৎ সাধারণ বাড়ির মতোউ দৈর্ঘ প্রস্থে বিস্তৃত। কান্দাভন গ্রামের লোকজন অবশ্য একটু উচ্চতাতেই ঘরবাড়ি তৈরি করতে পছন্দ করে। মজার ব্যাপার হলো কারা’নগুলো কিন্তু কয়েকতলা বিশিষ্টও হয়। এগুলোর নীচতলাটিতে রয়েছে পশুদের বাসস্থান যাকে আমরা গোয়ালঘর বলে থাকি। আর উপরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলাগুলোতে থাকে গ্রামবাসীদের আবাসন ব্যবস্থা।

কারা’নগুলোর ভেতরে তাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে দেয়াল কেটে কেটে। এসব তাকে বাতি, চেরাগ, আয়না, বইপুস্তকসহ এ ধরনের জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। আগেকার দিনে প্রত্যেকটি কারা’নের বাইরে মূল প্রবেশদ্বারের পাশে একটি করে হাউজ বা জলাধার থাকতো। অজু, গোসল, জামা কাপড়, হাঁড়ি পাতিল ধোয়ার কাজ এখানেই করা হতো। বর্তমানে অবশ্য এগুলোর ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না কেননা এখন সর্বত্রই পানির পাইপ লাইন চলে গেছে। জলাধারের পাশাপাশি চৌকিরও ব্যবস্থা ছিল। ক্লান্ত শ্রান্ত গ্রামবাসীরা এই চৌকিতে বিশ্রাম নিতো। চৌকিগুলো জাজিম বা কার্পেট মোড়ানো থাকতো। বাইরের বাতাস যাতে খুব সহজেই কারা’নের ভেতরে ঢুকানো যায় কিংবা ঢোকা বন্ধ করা যায় সেই ব্যবস্থা রয়েছে এগুলোতে। এর ফলে গরমের সময় বাইরের বাতাস ভেতরে ঢোকানো যায় যাতে ভেতরের পরিবেশ থাকে ঠাণ্ডা আর শীতকালে বন্ধ করে দিয়ে ভেতরের পরিবেশটাকে উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারা’নগুলোর অধিকাংশই দক্ষিণমুখী করে বানানো। এর কারণ হলো সূর্যের আলোকে যেন ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানো যায়।
কারা’নগুলো যেহেতু কঠিন প্রস্তর কেটে কেটে বানানো, ফলে বোঝাই যাচ্ছে কতো কঠিন একটি কাজ এটি। আর এই কাঠিন্যের কারণে কারা’নগুলোর প্রবেশদ্বারগুলো ছোট্ট করে বানানো হয়েছে। দরোজাগুলোর উচ্চতা এক শ’ ষাট সেন্টিমিটারের বেশি নয় কোনোভাবেই। আর এর প্রস্থ এক মিটার থেকে এক মিটার বিশ সেন্টের মতো। শ্রোতাবন্ধুরা! কান্দাভন গ্রামের আবহাওয়া যেহেতু খুবই উপভোগ্য,সেজন্যে এই গ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকার মাটিও খুবই উর্বর অর্থাৎ কৃষিকাজের উপযোগী। এই উঁচু ভূমিতেও তাই চমৎকার কৃষিকাজ হয়। কান্দাভনের উত্তর এবং দক্ষিণ উপত্যকার পরিবেশ একেবারেই সবুজ শ্যামল। সমগ্র ইরানের পার্বত্য এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম আবহাওয়া বিরাজ করে এই কান্দাভন পল্লীতে। এই পল্লীতে প্রায় সাত লাখ মানুষের বসবাস। জাজিম, কার্পেট, সতরঞ্জি ইত্যাদির মতো হাতে বোণা জিনিসগুলো এই গ্রামে তৈরি হয়। শুকনো মশলাপাতিও এখানে তৈরি করা হয় প্রচুর। বাদাম, মধু, আখরোট ইত্যাদির পাশাপাশি বিচিত্র ভেষজ উদ্ভিদ তথা ওষধি উদ্ভিদও এখানে রয়েছে প্রচুর।*
পার্সপুডে/নাসির মাহমুদ/২৮/টি-৪৩/অ-৪৩