আগস্ট ০১, ২০১৬ ১৫:১৪ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম যে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশটি কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্যেই বিখ্যাত নয় বরং এখানকার হস্তশিল্প পণ্যসামগ্রীর সৌন্দর্যও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। এ কারণে শিল্পপ্রেমীদের কাছে ইরানের এই ভূখণ্ডটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে গৃহীত। আমরা তাই পূর্ব আজারবাইজানেরই সুন্দর সুন্দর হস্তশিল্প এবং এখানকার ঐতিহাসিক কিছু নিদর্শনের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।

পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশটিকে ইরানের হস্তশিল্প সামগ্রীর একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল বলে মনে করা হয়। এই প্রদেশের উন্নত হস্তশিল্পের মধ্যে রয়েছে গালিচা বোণা, গেলিম বোণা, কাঠের শিল্প সামগ্রী, পশম বা রেশম দিয়ে বোণা ঐতিহ্যবাহী পণ্য সামগ্রী, প্রাচীন স্টাইলের ছাপার কাজ, কাঁচের কাজ, মৃৎ শিল্প, স্টিলের শিল্প সামগ্রী, খোদাইকর্ম, পলিশ করার কাজ, বইয়ের অঙ্গসজ্জা, মিনিয়েচার ইত্যাদি। যতোগুলো শিল্পের কথা আমরা বললাম, ছোট্ট এ আসরে সবগুলো শিল্পের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সেজন্যে গুরুত্বপূর্ণ কটি শিল্পের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

পূর্ব আজারবাইজানের হস্তশিল্প

কার্পেট বোণার ক্ষেত্রে পূর্ব আজারবাইজানের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন এবং স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং খ্যাতিময়। ইরানী কার্পেটের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কার্পেট বলতে তাব্রিযের কথাটিই সবার আগে উঠে আসবে। আর তাব্রিযের নামটি শোনার সাথে সাথে এই শহরের অন্যান্য বহু পণ্যের মাঝে সবার আগে এখানকার মনোরম কার্পেটের চিত্রই স্মৃতিপটে ভেসে উঠবে। এখানকার বিখ্যাত এবং দক্ষ শিল্পীরা সবসময়ই এই চিন্তাতেই বিভোর থাকতেন-কীভাবে আরো সুন্দর কার্পেট তৈরি করা যায়! এভাবে নিরন্তর সৃষ্টিশীল চিন্তার ফলেই তাঁরা তৈরি করতে পেরেছেন কালজয়ী সব শিল্প-যেগুলো আজো দর্শকদের আকৃষ্ট করে যাচ্ছে সমানভাবে। এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হিজরি তৃতীয় শতকে আজারবাইজান ছিল কার্পেট বুনন শিল্পের দিক থেকে সবচেয়ে নামকরা এবং বৃহত্তম কেন্দ্র।

পূর্ব আজারবাইজানের হস্তশিল্প

খ্রিষ্টিয় এগারো শতক থেকে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত সেলজুকি ও এইলখানীয় শাসনামলে আজারবাইজানে গালিচা বুনন শিল্পের চর্চা হয়েছিল পুরোদমে। তৈমুরীয় কিংবা তার পরবর্তীকালে সাফাভি শাসনামলে কার্পেট বুনন শিল্পের ঐতিহ্যের ধারা একেবারে তুঙ্গে ওঠে। সে সময়কার নিজামির বইগুলোতে যেসব মিনিয়েচারের কাজ হয়েছে সেগুলোই তার প্রমাণ। “কাসেম আলী” সহ অন্যান্য গ্রন্থেও লক্ষ্য করা গেছে সেগুলোতে গালিচার নকশা এবং বুননরীতির ছাপ পড়েছে। সে সময়কার কার্পেটের নমুনা এখনো বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা মিউজিয়ামগুলোতে লক্ষ্য করা যাবে। আজারবাইজান কিন্তু আজো ইরানের মধ্যে বিচিত্র কার্পেট বা কার্পেট জাতীয় বুনন শিল্পের জন্যে বিখ্যাত। আজারবাইজানের গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত কার্পেট বোনার রেওয়াজ ছিল এবং এখনো পুরোপুরি চালু আছে। গালিচা বুনন শিল্পটা আজারবাইজানের শহরগুলোতে কারখানায় অর্থাৎ ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয় আর গ্রামেগঞ্জে ততোটা ব্যাপকভাবে হয় না বরং ঘরে ঘরে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়। তো গ্রামেই হোক আর শহরেই হোক, এখানকার উৎপাদিত বিচিত্র নকশা ও ডিজাইনের গালিচা বা কার্পেটগুলো দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই এমনকি দেশের বাইরেও প্রচুর পরিমাণে রপ্তানী করা হয়। 

পূর্ব আজারবাইজানের হস্তশিল্প

তাব্রিয শহরটি ইরানে গালিচা বোনার জন্যে একটি প্রধান অঞ্চল। খ্রিষ্টিয় তেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাৎ হালাকু খান মোঙ্গলের সময় এবং তার পরবর্তীকালে তাব্রিয শহরটি ছিল গালিচা বা কার্পেট ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তাব্রিযের গালিচাগুলোর অনেক বৈশিষ্ট্যের মতো একটি হলো এখানকার কার্পেটের ডিজাইনগুলোতে প্রাচীন ঐতিহ্যকে অনুসরণ করা হয়। অন্তত তিন শ বছর থেকে এই শহরের গালিচাগুলোর ডিজাইনে মৌলিক কোনো পরিবর্তন দেখা যায় নি। এই ঐতিহ্যের ধারক কার্পেটগুলোর পাশাপাশি গালিচা বুনন শিল্পীরা তাদের সৃজনশীল মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন কিছু নমুনাও আবিষ্কার করেছেন। হাতে বোনা তাব্রিযি কার্পেটগুলোর উন্নত গুণ ও শৈল্পিক মানের কারণে যুগে যুগে এখানকার কার্পেট দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক বাজারে তাব্রিযের কার্পেট এক নামে সবার কাছেই পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারগুলোতে তাব্রিযের কার্পেটের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি।

আসরের শুরুতেই বলেছি যে তাব্রিযে বিচিত্র হস্তশিল্প রয়েছে। এখানকার তাব্রিয এবং যুনুর শহরে সিরামিকের তৈরি হস্তশিল্প পণ্য উৎপন্ন হয় প্রচুর। শাবেস্তারের যুনুর সিরামিক ফ্যাক্টরির বাইরেও এখানে বহুকাল ধরেই মৃৎ শিল্প উৎপাদিত হয়ে আসছে প্রচুর পরিমাণে। এখানকার মৃৎ শিল্প সমগ্র আজারবাইজানেই সরবরাহ করা হয়। সেলাইয়ের কাজ এ এলাকার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ হস্তশিল্প। তাব্রিয থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত মামাকন এলাকার একটি অংশে বহু আগে থেকেই শুচিকর্ম বা হাতে সেলাই করে কারুকাজ করার প্রচলন ছিল। কাপড়ের বিশাল ক্যানভাস বা জমিনজুড়ে রঙিন সিল্কের সূতা দিয়ে বিশেষ দক্ষতার সাথে সুঁই দিয়ে মনোরম কারুকাজ করতেন মামাকনের শিল্পীরা। আগেকার দিনেই একেবারে খাঁটি অর্থাৎ প্রাকৃতিক রেশমি সুতার ব্যবহার করেতেন শিল্পীরা। তবে বর্তমানে অরিজিনাল সিল্কের সুতার পরিবর্তে কৃত্রিম সিল্কের সুতারও ব্যবহার করা হচ্ছে। মামাকনের এই শিল্পটি নকশা বা ডিজাইনের দিক থেকে যেমন তেমনি সৌন্দর্যের দিক থেকেও ইরানের অন্যান্য অঞ্চল থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। মামাকনের এই সুচিকর্মের পণ্যগুলো টেবিল ক্লথ, বেড কভার, বিচিত্র ঢাকনার কভার ইত্যাদি জাতীয় কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে।

পূর্ব আজারবাইজানের হস্তশিল্প

পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের উস্‌কু শহরে আরেকটি হস্তশিল্পের প্রচলন রয়েছে। এটা আধুনিক যুগের বুটিক বা বাটিক শিল্পের মতো। বাটিক প্রিন্টটা প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রিন্টিং পদ্ধতির একটি। ইরানের একমাত্র শহর উস্‌কুতে এখনো এই প্রিন্টিংয়ের প্রচলন অব্যাহত আছে। মোম বাটিকেরও প্রচলন আছে এখানে। এখানে উৎপন্ন চমৎকার সব হস্তশিল্প সামগ্রী কেনার জন্যে সারাবছর জুড়েই দেশের ভেতর থেকে যেমন তেমনি বাইরে থেকেও বহু মানুষ আসেন। হস্তশিল্প সামগ্রী ছাড়াও তাব্রিযের শুকনো ফলফলাদি বেশ নামকরা। সারা বিশ্বেই শুকনো ফল বুট-বাদাম ইত্যাদির চাহিদা ব্যাপক। তাই বিদেশী অতিথিগণ এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে শুকনো ফলফলাদি কিনে নিয়ে যান।

পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের ঐতিহাসিক একটি নিদর্শন হচ্ছে প্রাচীন স্টেপানুস গির্যা।  জোলাফা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং সীমান্ত নদী আরাস বা স্থানীয় নাম গেযেল ভনাক থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে এই গির্যাটি অবস্থিত। ইরানের আর্মেনীয়দের গির্যাগুলোর মাঝে দ্বিতীয় প্রধান গির্যা এটি। খ্রিষ্টিয় নবম শতকে এই গির্যাটি নির্মিত হয়েছে। তবে ভূমিকম্পের কারণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/১/টি-৪৫/অ-৪৫