আগস্ট ২০, ২০১৬ ১৯:২৪ Asia/Dhaka

সুরা নাহলে রয়েছে মোট ১২৮ আয়াত। এর কিছু অংশ নাজিল হয়েছিল পবিত্র মক্কায় ও কিছু অংশ নাজিল হয়েছিল পবিত্র মদিনাতে। মানুষের জন্য নানা জন্তু, গাছপালা, ফল ও খাদ্যসহ মহান আল্লাহর নানা নেয়ামত সম্পর্কে এই সুরায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা দেখা যায়। এসবেই রয়েছে মানুষের জন্য নানা উপকার ও বরকত। তাই মানুষের উচিত সব সময়ই মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।

এই সুরাকে নাহল নাম দেয়া হয়েছে। কারণ, এতে মৌমাছি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। মৌমাছি এক বিস্ময়কর পতঙ্গ যা মহান আল্লাহর নিদর্শন। মৌমাছির সুবাদে আমরা পাই উৎকৃষ্ট খাদ্য মধু যাতে রয়েছে অনেক রোগের ওষুধ।

একত্ববাদের নানা যুক্তি, সৃষ্টির মহিমা, পরকাল, মুশরিকদের হুমকি, ন্যায়বিচার, দয়া বা উপকার করা, জিহাদ, হিজরত ও পরকাল সুরা নাহলের কয়েকটি আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়াও জুলুম, ব্যভিচার ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে এই সুরায়।

মক্কার মুশরিকরা বিশ্বনবী (সা.)-কে বলত, আপনি যদি সত্যিই আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের জন্য আল্লাহর শাস্তি নাজিল করে দেখান! কিন্তু অশেষ দয়াময় আল্লাহ শাস্তি নাজিল করতে বিলম্ব করতেন যাতে তারা চিন্তা-ভাবনার যথেষ্ট সুযোগ পায় ও গোঁড়ামি হতে মুক্ত হয়ে আল্লাহর মহাকরুণার পাত্র হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।  

কিন্তু মুশরিকরা এই সুযোগ গ্রহণ করেনি। বরং তারা মহানবী (সা.)’র তাওহিদি মিশনের সঙ্গে শত্রুতা দিনকে দিন জোরদার করে এবং বিশ্বনবীকে (সা.) নানা কটূক্তি ও উপহাস করতে থাকে। তাই মহানবীকে (সা.) সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নাজিল হয় সুরা নাহলের প্রথম আয়াত। এই আয়াতে শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলছেন:

‘(মুশরিকদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে) আল্লাহর নির্দেশ এসে গেছে। তাই এর জন্যে তাড়াহুড়া করো না বা তা ত্বরান্বিত করতে চেও না। তিনি মহাপবিত্র বা ত্রুটিমুক্ত ও ওরা যেসব শরিক সাব্যস্ত করছে সেসব থেকে বহু উর্ধ্বে। তিনি নিজ নির্দেশে বান্দাদের মধ্যে যার কাছে ইচ্ছা, ঐশী প্রত্যাদেশ বা ওহিসহ ফেরেশতাদেরকে এই মর্মে নাজিল করেন যে, মানুষকে হুঁশিয়ার করে দাও, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তাই কেবল আমাকেই ভয় কর তথা আমার শাস্তি থেকে নিজেদের রক্ষা কর।’

মানুষকে শিরক বা অংশীবাদিতা থেকে মুক্ত করতে ও এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী করতে সুরা নাহলে সৃষ্টি জগতের নানা বিস্ময়কর বিষয় এবং মহান আল্লাহর নানা নেয়ামতের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

সুরা নাহলের তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,

‘যিনি সত্যের ভিত্তিতে (মহান কিছু লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে) আকাশরাজি ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। তারা যাকে শরিক করে তিনি তার বহু উর্ধ্বে। তিনি মানবকে এক ফোটা বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন।  তা সত্বেও সে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী হয়ে গেছে তথা শত্রু  হয়ে গেছে।’

মানুষ একটি তুচ্ছ বস্তু থেকে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও তার অহংকার এত বেশি যে সে আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলসহ সব কিছুর স্রস্টা মহান আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতার ঘোষণা দেয় প্রকাশ্যেই!

মানুষ সৃষ্টির বিষয়ে কথা বলার পর মহান আল্লাহ চতুষ্পদ জন্তু ও এসবের উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। মহান আল্লাহ বলছেন:

‘ তৃণভোজী ও গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। এতে তোমাদের জন্যে শীত বস্ত্রের উপকরণ আছে। আরও অনেক উপকার রয়েছে এবং কিছু সংখ্যককে তোমরা খাদ্যে পরিণত করে থাক। এর মধ্যে তোমাদের জন্য সৌন্দর্যের উপকরণ রয়েছে যখন বিকালে এই পশুদের চারণভূমি থেকে নিয়ে আস এবং সকালে চারণ ভূমিতে নিয়ে যাও।’

শীতের নানা পোশাক, লেপ-কাঁথা, জুতা, টুপি ও তাবু-ইত্যাদির উপকরণ আসে পশুর পশম বা চামড়া থেকে। এ ছাড়াও এইসব পশুর দুধ ও দুগ্ধজাত নানা খাদ্য এবং গোশত মানুষের জন্য খুবই উপকারী। পোশাক ও বাসস্থান মানুষের জন্য জরুরি বা অপরিহার্য চাহিদা। আর এসবই মানুষের জন্য মহান আল্লাহর নেয়ামত। বিশাল পশুর পাল মানুষের জন্য দৃষ্টিনন্দন ও সমাজের অর্থনৈতিক কর্মপ্রেরণার উৎস। অন্য কথায় পরিশ্রম ছাড়া ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি হয় না। বলা হয় গতিতে জীবন মম স্থিতিতে মরণ। তাই দারিদ্র বিমোচন এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য কৃষি ও পশুসম্পদসহ প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার জরুরি। গৃহপালিত পশু সম্পর্কে সুরা নাহলের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,

'(৭) এবং এসব পশু তোমাদের ভার বহন করে এমন শহরে নিয়ে যায় যেখানে তোমরা প্রাণান্তকর পরিশ্রম ছাড়া পৌঁছতে সক্ষম ছিলে না; নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রতিপালক অত্যন্ত দয়ার্দ্র, অনন্ত করুণাময়। (৮) এবং তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা এগুলোতে চড়তে পার এবং (তোমাদের জন্য) সৌন্দর্যের উপকরণ হয় এবং তিনি এমন কিছু (বাহন) সৃষ্টি করেন যা তোমরা জান না।'

ভেবে দেখার বিষয় হল, এইসব শক্তিশালী পশুকে মহান আল্লাহই মানুষের জন্য বশীভূত করেছেন। এমনকি এই আধুনিক যান্ত্রিক-প্রযুক্তির যুগেও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হল এইসব চতুষ্পদ জন্তু। ঘোড়া ও এ জাতীয় চতুষ্পদ জন্তুগুলো এক ধরনের শোভা হিসেবেও বিবেচিত হয়।

সুরা নাহলের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

'(১০) তিনিই (তোমাদের জন্য) আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাক। (১১) এ (পানি) দিয়ে তিনি তোমাদের জন্য শস্য, জয়তুন, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সব ধরনের ফল উৎপন্ন করেন; নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।'

বৃষ্টি মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটায়। এ ছাড়াও কৃষি কাজের জন্য বৃষ্টি অপরিহার্য। এই পানি ছাড়া নানা ধরনের শস্য, উদ্ভিদ ও ফল গাছের চাষ হত অসম্ভব। তাই বৃষ্টির পানি ও বিচিত্রময় শস্য আর ফল-এসবই মহান আল্লাহর দয়ার নিদর্শন। বিজ্ঞানীদের মতে নানা ধরনের ফলের মধ্যে জয়তুন, খেজুর ও আঙ্গুর অন্য অনেক ফলের তুলনায় খুবই উন্নত এবং সমৃদ্ধ খাদ্যগুণ-সম্পন্ন ও উপকারী।

জয়তুনের তেল যকৃত ও কিডনির নানা সমস্যা ও পিত্ত-থলের পাথর অপসারণের জন্য উপকারী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। খেজুরের ক্যালসিয়াম হাড়কে মজবুত করে। এই ফলের ফসফরাস মস্তিষ্কের সক্রিয়তার জন্য উপকারী। খেজুর স্নায়বিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি ঘোচাতেও সহায়তা করে। খেজুরে পটাশিয়াম থাকায় তা শরীরের পেশির জন্য সহায়ক। খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে আঙ্গুরের উপকারী উপাদান এত বেশি যে তা যেন এক প্রাকৃতিক ঔষধালয়। এই ফল রক্ত পরিষ্কার করে এবং বাত ও গেটে বাত রোধ করে।  আঙ্গুর কোষ্ঠ পরিষ্কার করে এবং স্নায়ুকেও করে সতেজ। ফলে ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয় এবং চিত্ত হয় প্রফুল্ল। পরবর্তী আয়াতে পৃথিবীকে স্থির রাখতে পাহাড়ের ভূমিকা, ভূমির সমতল হওয়ার সুবিধা, মানুষের জীবনে নানা ধরনের রং ও সাগরের ভূমিকা-এসবের কথা এসেছে যা মহান আল্লাহর অসীম শক্তিমত্তা এবং অনুপম কৌশলের কিছু নিদর্শন।#