আগস্ট ২৪, ২০১৬ ১৮:৫৮ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছিলাম। সেইসাথে এই প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর উরুমিয়ের ঐতিহাসিক এবং চমৎকার কিছু দিকের ওপরও আলোচনা করেছিলাম। আজকের পর্বে আমরা উরুমিয়ে শহর পরিদর্শনে যাবো এবং বিশেষ করে এই শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শনের সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।

উরুমিয়ে শহরটি পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানে প্রাকৃতিক লীলাবৈচিত্র যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছৈ ঐতিহাসিক অনেক নিদর্শনও। এ কারণেই উরুমিয়ে শহরটি অন্যতম একটি ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে সমাদৃতি পেয়েছে। উরুমিয়ে হ্রদের ন্যাশনাল পার্ক, অসংখ্য ঝর্ণাধারার পাশাপাশি এখানে রয়েছে উঁচু উঁচু বহু পাহাড় পর্বত, রয়েছে বিস্তীর্ণ অনেক চারণভূমি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে চমৎকার দ্বীপময় এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি উরুমিয়ে হ্রদের সৌন্দর্য। এখানে যে ঝর্ণাধারাগুলো রয়েছে সেগুলোর একটা বিশেষত্ব রয়েছে, তাহলো এগুলোর পানির ওষুধি গুণ রয়েছে। এ কারণে এই এলাকাটিকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সৌন্দর্যের দিক থেকে উরুমিয়ে হ্রদটির খ্যাতি সমগ্র ইরান জুড়েই রয়েছে। তাছাড়া উরুমিয়ে এলাকাটির ঐতিহ্যও বেশ প্রাচীন।

Image Caption

ইতিহাসের অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পরও এখানে গড়ে উঠেছে বহু স্থাপনা। ঐতিহাসিক এইসব স্থাপনার বাইরেও প্রাকৃতিকভাবে এখানে রয়েছে অনেক নিদর্শন। রয়েছে বাইশটি প্রাচীন টীলা। উরুমিয়ে এলাকার আশেপাশে বিদ্যমান এইসব টীলা থেকেই অনুমিত হয় যে এই এলাকাটি বা শহরটি কতো প্রাচীন। পুরাতাত্ত্বিক গবেষকগণ এখানে খনন কাজ চালিয়ে প্রাচীন একটি ফলক আবিষ্কার করেছে। “গুগে থাপ্‌পে” নামক এই টীলায় আবিষ্কৃত ফলকটি খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর আগের বলে অভিমত দিয়েছেন গবেষকগণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে এখনো ঐ ফলকটি সংরক্ষিত আছে।

উরুমিয়ে শহরাঞ্চলে বহু মসজিদও রয়েছে। এসব মসজিদের কোনো কোনোটি এ অঞ্চলের দর্শনীয় নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত। মসজিদের পাশাপাশি উরুমিয়ে শহরের আশেপাশে রয়েছে বেশ কিছু গীর্যাও। ঐতিহাসিক স্থাপনার নিদর্শন হিসেবে এসব গীর্যার স্থাপত্যমূল্য সবার কাছেই স্বীকৃত।

“মারকুমা” নামে ঐতিহাসিক গীর্যাটি খুবই নামকরা। প্রাচীন ঐতিহ্যের এই ধর্মীয় স্থাপনাটির প্রাচীনত্ব দেখলেই বোঝা যায় শহরটি কতো আগে থেকেই আবাদি ছিল। মারকুমা গীর্যাটি ইসা মাসিহ (আ) এর বারোজন ভক্তের একজন ‘কুমা’র সাথে সম্পৃক্ত বলে ইতিহাসবিদদের অভিমত। একইভাবে প্রাচীন আরেকটি গীর্যা হলো “মায়ূখান্না” গীর্যা। এই গীর্যাটির স্থাপত্যশৈলীর দিকে তাকালে সহজেই অনুমিত হয় যে এটি খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকের স্থাপনা। গীর্যাটির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গীর্যা ছাড়াও এখানে রয়েছে অসংখ্য দূর্গ, সেতু, স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাম্মামখানা, কবরস্থান, বড়ো বড়ো ইমারত, শিলালিপী ইত্যাদি।। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি হলো এখানকার বাজার অর্থাৎ উরুমিয়ে বাজার কমপ্লেক্স। ঐতিহাসিক এই বাজারটি উরুমিয়ে এলাকার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। অনেক নিদর্শনের কথা বললাম কিন্তু ছোট্ট এবং সীমিত সময়ের মধ্যে তো আর সব বিষয় নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়, তাই যতোটা সংক্ষেপে সম্ভব আমরা খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

উরুমিয়ে হ্রদ

ইসলামী সভ্যতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাময় দুটি স্থাপনা এই উরুমিয়েতে রয়েছে।  একটি হলো তিন গম্বুজ টাওয়ার এবং অপরটি হলো এখানকার জামে মসজিদ। খ্রিষ্টিয় তেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর একটি হলো এই জামে মসজিদ। উরুমিয়ে শহরে প্রাচীন যে বাজারটি রয়েছে সেই বাজারের ঠিক মাঝখানে এই জামে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির বেশ বড়ো সড়ো খোলা আঙ্গিনা রয়েছে, রয়েছে বিশাল শাবেস্তানও। শাবেস্তানটি ইটের তৈরি। শাবেস্তানের ঠিক মাঝখানটায় বড়ো একটি গম্বুজ রয়েছে, বলা যায় গম্বুজটি পুরো শাবেস্তানটাকেই ঢেকে রেখেছে। মসজিদটির মেহরাবে চকের কারুকাজ চোখে পড়ার মতো সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন। হিজরি ১১৮৪ সালে এই মসজিদটির মেরামত কাজ হয়েছিল।

তিন গম্বুজ স্থাপনাটি আসলে টাওয়ারের আদলে একটি সমাধিস্থল বৈ ত নয়। উরুমিয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে এই স্থাপনাটি পড়েছে। খ্রিষ্টিয় বারো শতকের স্থাপত্য নিদর্শন এই তিন গম্বুজ টাওয়ারটি। টাওয়ারটির নীচে ভূগর্ভস্থ সমাধি রয়েছে। সমাধিটির একটি সুন্দর প্রবেশদ্বার রয়েছে বেশ কারুকার্জ খচিত। অনেক পুরাতাত্ত্বিকের মতে এই স্থাপনাটির পাশে আরো দুটি স্থাপনা ছিল। সেই স্থাপনাগুলোরও গম্বুজ ছিল। এ কারণেই এই কমপ্লেক্সটিকে তিন গম্বুজ স্থাপনা নামে অভিহিত করা হয়েছে।

মারিয়াম গির্জা

উরুমিয়েসহ পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে প্রাচীন অনেক ভবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ছাড়াও এইসব ভবনের সৌন্দর্য এবং নির্মাণ শৈলী খুবই আকর্ষণীয়। এইসব ভবনের স্থাপত্যশৈলীতে আয়নার কারুকাজ, চকের কারুকাজ, চমৎকার সব ডিজাইনের কার্ণিশ, অন্যান্য শিল্পকর্ম, বিচিত্র নকশা, চকের ভাস্কর্য, কাঠের তৈরি চমৎকার রেলিং ইত্যাদি আরো চমৎকৃতি দান করেছে।

সংস্থা বা ইউনিয়ন বিল্ডিং, স্বেচ্ছাসেবীদের কার্যালয় এবং প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানকার সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে সংস্থা ভবনটি উরুমিয়ে শহরের প্রাচীন এবং আকর্ষণীয় ভবনগুলোর অন্যতম। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে উরুমিয়ে শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী মির্যা অগা’ এত্তেহাদিয়ের সমকালীন স্থাপনা এটি। মজার ব্যঅপার হলো এই স্থাপনাটি গড়ে তোলা হয়েছে নবনির্মিত একটি ভবনের মাঝখানে। স্বেচ্ছাসেবক বা আনসারী হাউজও শতাধিক বছর আগের স্থাপনা। কাজারি শাসনামলের শেষ সময়ে এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল মনে করা হয়। হেদায়াত মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিও একই সময়ের স্থাপনা বলে বিশেষজ্ঞমহলের ধারণা। ইতিহাসে এসেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ফরাশি বাহিনী এই স্থাপনাটি অল্প সময়ের জন্যে ব্যবহার করেছিল।

 উরুমিয়ের মিউজিয়ামটিও একটি দশর্নীয় স্থাপনা। ১৯৬৭ সালে এই যাদুঘরটি নির্মিত হয়েছিল। মিউজিয়ামের ভেতরে বিশাল একটি অডিটোরিয়াম রয়েছে, রয়েছে প্রাচীন বা ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রদর্শনীর আয়োজন। অ্যানথ্রোপোলজি বা নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান যাদুঘর হিসেবেই এই যাদুঘরটিকে সবাই চেনে। এই যাদুঘরটিতে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো কুরআনসহ ধর্মীয় বিভিন্ন ক্যালিগ্রাফির খুবই সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। প্রাগৈতিহাসিককালেরও বহু নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন এখানে সংগ্রহীত আছে, আছে অনেক মূল্যবান হস্তশিল্প সামগ্রীও। উরুমিয়ে যাদুঘরটিকে ইরানের সমৃদ্ধ যাদুঘরগুলোর একটি বলে মনে করা হয়। এখানকার সর্বপ্রাচীন নিদর্শনটির বয়স খ্রিষ্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগের। তবে সবচেয়ে নতুন যে নিদর্শনটি এই যাদুঘরে স্থান পেয়েছে সেটি কাজারি শাসনামলের।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি:৪৭/অ:৪৭/এ:৪৭