দেখব ঘুরে ইরান এবার:পশ্চিম আজারবাইজানের উরুমিয়ে হ্রদ
গত পর্বে আমরা পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর উরুমিয়ের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছিলাম। বলেছিলাম যে উরুমিয়ের হ্রদের পাশেই উরুমিয়ে শহরটি অবস্থিত। উরুমিয়ে হ্রদটি বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান লবণ হ্রদ। যার ফলে এই হ্রদটি অন্যতম একটি ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে পরিচিত। সত্যিই দেখার মতো অনেক কিছু আছে এখানে।
বিশ্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণাগার হিসেবে এই উরুমিয়ে হ্রদটিকে বিশ্ব সংস্থা ইউনেস্কো’র পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যাই হোক এই হ্রদটির আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজকের পর্বে আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের উরুমিয়ে হ্রদটি সমগ্র ইরানের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো হ্রদ। এই হ্রদটির আয়তন পাঁচ হাজার সাত শ’ বর্গকিলোমিটার। দৈর্ঘে এটি ১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটারের মতো আর প্রস্থে ১৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার। এর উচ্চতা হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার দুই শ’ সাতষট্টি মিটার। হ্রদটির সবচেয়ে গভীরতা যে অংশে সেখানকার গভীরতা হলো ১৫ মিটারের মতো, তবে গড় গভীরতা ৫ মিটারের মতো। এই হ্রদ উপযুক্ত প্রকৃতির দিক থেকে বিরল প্রজাতির পাখপাখালির স্থায়ী বসবাসের যোগ্য। দ্বীপ এবং উপকূলীয় প্রকৃতির সৌন্দর্য বিবেচনায় উরুমিয়ে হ্রদটিকে ইউনেস্কো পাখিদের বাস যোগ্য বলে চিহ্নিত করেছে। এমনিতেই হ্রদটি বেশ সুন্দর, তদুপরি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম লবণক্ষেত্রগুলোর অন্যতম হিসেবেও এর খ্যাতি রয়েছে। হ্রদটির ভেতরে ছোটো বড়ো মিলিয়ে শতাধিক দ্বীপ রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কটি হলো ইসলামী আবাসিক দ্বীপ, কাবুদন স্পির দ্বীপ, আশ্ক এবং আরজু দ্বীপ ইত্যাদি।

উরুমিয়ে হ্রদের পানির প্রধান উৎস হলো পাহাড়ের উচ্চতা থেকে নেমে আসা নিরন্তর ঝর্ণাধারা থেকে সৃষ্ট নদীমালা। নদীগুলোর নামও বেশ মজার। তালখে রুদ বা অজি চয়ি, সুফি চয়ি, যারিনে রুদ, সিমিনে রুদ, শাহরিয়ে চয়ি, মাহাবদ রুদ, নাযলু চয়ি ইত্যাদি। উরুমিয়ে হ্রদের পানির লবণাক্ততার একটা কারণ হলো হ্রদের উত্তর দিকটাতে রয়েছে লবণের বিশাল বিশাল স্তুপ-দেখতে অনেকটা গম্বুজের মতো মনে হয়। তাছাড়া অজি চয়ি বা তালখে রুদের মাধ্যমেও প্রচুর পরিমাণ লবণ ঢোকে এই হ্রদটিতে। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে যে বিষয়টি ঘটে সেটা হলো শীতকালে প্রচণ্ড বরফের সময়ও এই হ্রদে বরফ জমে না। এই বরফ না জমার কারণে এখানে বিদেশী পাখি যাকে আমরা অতিথি পাখি বলে অভিহিত করে থাকি, সেইসব পাখির প্রচুর আনাগোণা ঘটে। একেবারে পাখিতে ভরে যায় পুরো হ্রদ। পাখিদের ওড়াউড়ি, বিচিত্র শব্দের কূজনে কী যে অপরূপ এক দৃশ্যের অবতারণা হয় এখানে, শীতকালে কেউ এই হ্রদে না গেলে বোঝানো যাবে না।
গ্রীষ্মের সময় এখানকার স্থানীয় এবং অস্থানীয় পর্যটকেরা হ্রদে নেমে গোসল করেন। লবণাক্ততার কারণে এখানকার পানিও স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো বিশেষ করে যাদের রিওম্যাটিজম আছে কিংবা বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ আছে, তাদের জন্যে খুবই উপকারী এই হ্রদের পানি। গরম পড়লেই হ্রদের উপকূল জুড়ে তাঁবু উঠতে থাকে। এইসব তাঁবুতে দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকগণ অবকাশ যাপন করেন আর হ্রদের বিশেষত্বপূর্ণ আরোগ্যদানকারী পানির ব্যবহার করেন।
উরুমিয়ে হ্রদের এতোসব ভালো ভালো গুণ থাকার পরও সমস্যারও কিছু দিক আছে। যেমন অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে এই হ্রদের পানিতে মাছ কিংবা জলে বাস করে এমন প্রাণী বসবাস করতে পারে না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে এই হ্রদে আর্টেমিয়া এবং জুপ্লাংটন নামে এক ধরনের মৈবাল কিংবা অমেরুদন্ডী প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। ওই শৈবাল জাতীয় জুপ্লাংটন বা ফাইটোপ্লাংটন গুলোর ওপর সবুজাভ রঙের একটি আস্তরন পড়ে। এগুলো আবার বিভিন্ন প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর্টেমিয়ার গঠনটি বেশ শক্ত এবং পুরু। এগুলোর খাদ্যমান খুবই উন্নত। প্রচণ্ড লবণাক্ত পানিতেই এগুলো হয়ে থাকে। পাখি কিংবা চিংড়ি মাছ জাতীয় মাছেরা এগুলো প্রচুর পরিমাণে খায়। এগুলোর রঙ কিছুটা সোনালী হবার কারণে উরুমিয়ে হ্রদের স্বর্ণ নামেই এগুলো প্রসিদ্ধি পেয়েছে।

উরুমিয়ে হ্রদের জলে ছোটো বড়ো মিলিয়ে শতাধিক দ্বীপ রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই পাথুরে দ্বীপ। এখানে তাই বিচিত্র প্রাণীর বেড়ে ওঠার সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে তেমনি এখানে বেড়ে উঠেছে বিচিত্র উদ্ভিদও। এসবের বাইরেও এখানে রয়েছে ন্যাশনাল পার্ক। পার্কে যাবার আগে চলুন আমরা বরং যেটুকু সময় হাতে রয়েছে সেই সময়টুকুতে এখানকার অন্যান্য দ্বীপ বেড়িয়ে আসি।
ইসলামী দ্বীপ উরুমিয়ের সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ। অনেকটা উপদ্বীপের মতোই বৃহৎ। এই দ্বীপটি উরুমিয়ে হ্রদের মাঝে একমাত্র আবাসিক দ্বীপ। প্রায় ২৫ হাজার হিক্টর জায়গা জুড়ে এই দ্বীপটির অবস্থান। তবে এই দ্বীপটির বৈশিষ্ট্য হলো এখানে রয়েছে মিষ্টি পানির ধারা। যার ফলে এখানে আবাস গড়ে উঠেছে প্রচুর। বহু পরিবার এখানে বাস করে। সাধারণত যারা কৃষিকাজ করে কিংবা পশুপালন করে তারাই এখানে বেশিরভাগ বসবাস করে।
এই দ্বীপের বাসিন্দারা তাদের প্রয়োজনীয় পানির সংকুলান করে থাকে এখঅনকার অসংখ্য ঝর্ণাধারা থেকে। এই দ্বীপে রয়েছে সুউচ্চ পর্বত চূড়া। ঐ চূড়ায় রয়েছে হালাকু খানের দূর্গ। সেইসাথে রয়েছে বহু মোগল শাসকের কবর। হিজরি সপ্তম শতকে এইলখান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হালাকু খানের আদেশে এই কেল্লাটিকে পুনর্নিমাণ করা হয়। বাগদাদসহ অন্যান্য ইসলামী ভূখণ্ড থেকে যেসব মালামাল লুটপাট করেছিল তারা সেগুলো এখানেই সংরক্ষণ করেছিল। ঐতিহাসিক তথপঞ্জি অনুযায়ী অবশেষে এই কেল্লাতেই হালাকু খানেকে দাফন করা হয়েছিল। এ কারণে ফার্সি ভাষায় এই কেল্লাটিকে “গোর কেল্লা” নামেও অভিহিত করা হয়।
উরুমিয়ে হ্রদের আরো একটি দ্বীপ হলো ‘কাবুদন’ দ্বীপ। এই দ্বীপটি অবশ্য অনাবাসিক। এই দ্বীপটির আয়তন আনুমানিক তিন হাজার দুই শ’হেক্টর। এখানে অবশ্য হিংস্র প্রাণীদের বাস রয়েছে। চিতাবাঘ এবং মেষও আছে এই দ্বীপে। কাবুদন দ্বীপের সবুজ উদ্ভিদরাজির দৃশ্য চোখ ধাঁধাঁনো সুন্দর। একটা সময় দ্বীপটির দক্ষিণাঞ্চল ছিল আলবোর্য পর্বতমালার সাথে লাগোয়া আর পূর্বাঞ্চলীয় উপত্যকাটি ছিল যাগরোস পর্বতমালার সবুজে ঢাকা। এখানে রয়েছে বুনো বাদামগাছ, পার্বত্য বাদামগাছসহ বিচিত্রসব বৃক্ষরাজি। দ্বীপটির উত্তর দিকটায় রয়েছে ‘আরযু দ্বীপ’ আর পশ্চিম অংশে রয়েছে ‘স্পিরু দ্বীপ’। এগুলোর বাইরেও আরো বহু দ্বীপ রয়েছে এই উরুমিয়ে হ্রদে। সময় সুযোগ হলে ভবিষতে কখনো সেসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।*
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি:৪৭/অ:৪৭/এ:৪৭/২৭