দেখব ঘুরে ইরান এবার:পশ্চিম আজারবাইজানের তাকব শহর
আমরা পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর উরুমিয়ের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলির সাথেও পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। আজো আমরা এই প্রদেশেই থাকবো। তবে অন্য শহরে। শহরটির নাম হলো ‘তাকব’। তাকব শহরটিও বেশ সুন্দর।
তাকব শহরটি পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই শহরের কেন্দ্রটিও শহরের নামেই পরিচিত। তাকবের সাথে রয়েছে তিনটি প্রদেশের সীমান্ত। একটি হলে যানজন প্রদেশ, অপরটি পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশ আর তৃতীয় প্রদেশটি হলো কুর্দিস্তান। পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের অপরাপর এলাকার মতো তাকবও একটি কৃষিনির্ভর অঞ্চল। এর কারণ হলো এখানকার মাটি যথেষ্ট উর্বর আর এখানে পানির পর্যাপ্ত যোগান রয়েছে। গম, যব, বিচিত্র শস্যদানা, বহুরকমের উদ্ভিদ, আপেল, আঙ্গুর, যার্দালু ... ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ ফল ফলাদি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় এখানে। তাকব শহরে বিশাল বিশাল চারণভূমি থাকার কারণে এখানে পশুপালনেরও প্রচলন রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। পশুপালনকে কেন্দ্র করে এখানে দুগ্ধজাত পণ্য সামগ্রীও উৎপন্ন হয় প্রচুর। এসব পণ্য আঞ্চলিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানীও করা হয়। আরেকটি বিষয় এখানকার গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন, সেটা হলো মধু। এই এলাকার প্রায় সবাই কমবেশি মধুর চাষ করে, অনেকটা পারিবারিক পেশায় পরিণত হয়েছে মধুর চাষ।

তাকব এলাকাটিতে ইসলাম পূর্বকালের এবং ইসলাম পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর মাঝে ‘তাখতে সোলায়মান’ স্থাপনাটির নাম সবার আগে উঠে আসবে। তাকব শহর থেকে আনুমানিক ৪৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বদিকে তাখতে সোলায়মান অবস্থিত। এর বাইরেও এখানে রয়েছে সাসানী শাসনামলের বিশাল বিশাল অগ্নিমন্দির। এসব অগ্নিমন্দিরের মধ্যে অজার গোশাস্বের নাম উল্লেখ করার মতো। এখানে আরো রয়েছে প্রাচীন কেল্লা ‘সারুকুরখান’, রয়েছে তাকব জামে মসজিদসহ প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন। এগুলো তাকব অঞ্চলের পর্যটক আকর্ষণীয় এলাকা হিসেবেই পরিচিত। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে যে স্থাপনাটি সেটি হলো তাখতে সোলায়মান। চলুন ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটির সাথে আরেকটু ভালোভাবে পরিচিত হওয়া যাক।
তাখতে সোলায়মান শুধুমাত্র ইরানের মধ্যেই যে কেবল নামকরা একটি নিদর্শন, তা নয় বরং এই নিদর্শনটির ঐতিহাসিক মূল্য বিশ্বজনীন। এই বিশ্বজনীনতার কারণেই ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় বহু আগেই স্থান করে নিয়েছে স্থাপনাটি। ইরানের যতোগুলো নিদর্শন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে চার নম্বরে আছে তাখতে সোলায়মান। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি থেকেই অনুমান করা যায় যে এই এলাকায় কতো প্রাচীনকাল থেকে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক তথ্যপঞ্জি থেকে বলা হয়ে থাকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে এখানে মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক এই কমপ্লেক্সটির আয়তন এক লাখ চব্বিশ হাজার বর্গমিটার। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল মাদ্রা, আশকানিয়ানরা, সাসানীয়রা এমনকি মোঙ্গলরাও। ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ বলুন কিংবা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্যেই বলুন ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় এই এলাকাটি ইরানের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এবং অনন্য।

তাখতে সোলায়মান মূলত একটি বিশাল কেল্লা। কেল্লা বলাটা এখন আর বোধ হয় ঠিক হবে না কেননা এর এখন ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। সাসানীয় আমলের একটি অগ্নিমন্দিরসহ আরো বেশ কিছু নিদর্শন এখনো সেখানে লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন এই কেল্লাটির গঠন ডিম্বাকৃতির। সমতল ভূমি থেকে কিছুটা উচ্চতায় তৈরি করা হয়েছে কেল্লাটি। পুরো কেল্লার চারপাশে বিশাল প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের মাঝে মাঝে রয়েছে প্রতিরক্ষা টাওয়ার। অন্তত আটত্রিশটি প্রতিরক্ষা টাওয়ার আছে কেল্লাটিতে। কেল্লার প্রাচীরের উচ্চতা সবক্ষেত্রে সমান নয়। কোথাও বেশ উঁচু আবার কোথাও খানিকটা নীচু। তবে গড়ে ছয় থেকে আট মিটার উঁচু আর চার মিটারের মতো পুরু। সাসানী শাসনামলেই এই প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল তবে খ্রিষ্টিয় তেরো শতকে এইলখানিয়ানের সময় প্রাচীরের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশটুকু পুনরায় মেরামত করা হয়েছিল।
তারপরও বলতেই হবে সাসানী শাসনামলেই এই কেল্লাটির স্বর্ণযুগ ছিল। এই সময় অজার গাশস্ব নামের যে অগ্নিমন্দিরটি এখানে নির্মাণ করা হয়েছিল সেই অগ্নিমন্দিরটি ছিল সমকালীন যুগে অত্যন্ত সম্মানীয় ও মর্যাদার অধিকারী। এই অগ্নিমন্দিরটিই অবশেষে এইলখানিয়ান হুকুমাতের পরবর্তীকালে ‘তাখতে সোলায়মান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কেল্লাটির দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় অংশে চমৎকার একটি হ্রদ আছে ডিমের আকৃতির মতো। এখানে কয়েকটি ঝর্ণাধারাও রয়েছে। ঐসব ঝর্ণাধারার জলই এই হ্রদের পানির উৎস। হ্রদটির দৈর্ঘ ১২০ মিটার আর প্রস্থ ৮০ মিটার। আর হ্রদের গভীরতা হলো পঁয়ষট্টি মিটারের মতো। অনেক সময় হ্রদের পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে হ্রদের আশপাশে যেসব ক্যানেল তৈরি করা হয়েছে সেইসব ক্যানেলের মাধ্যমে হ্রদের বাড়তি পানি সরে যায়। ঐ পানি আবার কৃষিকাজের জন্যে ব্যবহৃত হয়। এই হ্রদটির পানিতে খনিজ লবণের পরিমাণ প্রচুর।
সাসানী শাসনামলের নিদর্শন ছাড়াও এখানে মোঙ্গল আমলেরও বেশ কিছু নিদর্শন চোখে পড়বে। এইসব নিদর্শন চক এবং টাইলসের কারুকাজে পূর্ণ। তাখতে সোলায়মানের টাইলসের বৈচিত্র এতো বেশি যে এগুলোকে বেশ কটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। তবে এগুলোর মাঝে ফিরোযা রঙের টাইলসগুলোর মর্যাদা এবং সৌন্দর্য অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। এগুলোতে রয়েছে সী-মোরগ এবং ড্রাগনের বিচিত্র নকশা। এই দুটি প্রাচীন রূপকথার প্রতীক। ক্রিষ্টিয় ৬২৪ সালে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস যে হামলা চালিয়েছিল, ঐ হামলায় চমৎকার এই স্থাপনাটি ধ্বংস হয়ে যায়।
তাকব জামে মসজিদের কথা বলেছিলাম। এটি এই শহরের আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। শতাধিক বছর আগে নির্মিত এই মসজিদটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। ঐতিহাসিক যেসব তথ্যপঞ্জি এ যাবৎ পাওয়া গেছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে খ্রিষ্টিয় ১৯২৪ সালে নাসের উদ্দিন শাহ কাজারের শাসনামলে হোসাইন আলী খান আফসরের নির্দেশে জামে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণশৈলী এবং কারুকাজের দিক থেকে এই মসজিদটির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। মসজিদ কমপ্লেক্সকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক বহু প্রতিষ্ঠানও।*
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি:৪৯/অ:৪৯/ই:৪৯/২৮