আগস্ট ২৯, ২০১৬ ১৬:০৯ Asia/Dhaka

গত পর্ব পর্যন্ত আমরা পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। এই প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর উরুমিয়ের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলির সাথেও পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। আজো আমরা এই প্রদেশেরই অন্য একটি শহরে বেড়াতে যাব ইনশাআল্লাহ। শহরটির নাম হলো ‘মাকু’। চলুন তাহলে সরাসরি চলেই যাই শহরটিতে।

মাকু শহরটি পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের একটি সীমান্ত শহর। শহর না বলে বরং পার্বত্য উপশহর বলাই ভালো। অসংখ্য পাহাড় রয়েছে এই উপশহরটিতে। এই শহরের কেন্দ্রে যারা বসবাস করেন তাঁদের বেশিরভাগই তুর্কিভাষী। তবে সীমান্ত এলাকায় যারা বাস করেন তাঁরা কুর্দি ভাষায় কথা বলেন। মাকু শহরের অধিকাংশ লোকজন মুসলমান হলেও আর্মেনীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরও বসবাস রয়েছে এখানে। মাকু শহরের কেন্দ্রীয় শহরটিও মাকু নামেই পরিচিত। এই শহরটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৩৪ মিটার। ভৌগোলিক এবং কৌশলগত দিক থেকে এই শহরটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু ইরানের সাথে আরো দুটি দেশের সীমান্ত রয়েছে এই শহরটির মধ্যদিয়ে সেহেতু এর গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। যেসব দেশের সাথে সীমান্ত রয়েছে এই শহরটির সেগুলো হচ্ছে তুরস্ক এবং আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র। কাস্টমস ডিউটি বা পণ্য আমদানি-রপ্তানি শূল্ক এলাকায় অবস্থানের কারণে মাকু শহর হয়েই ব্যবসায় কিংবা অন্যান্য যাত্রীদের যেতে হয় দেশের বাইরে। বিশেষ করে তুরস্কে যারা স্থলপথে যায় তাদেরকে এই মাকু শহর অতিক্রম করতে হয়। এসব কারণে প্রতিদিনই বহু মানুষ এই পথে অর্থাৎ মাকু শহরে যাতায়াত করে।

মাকু শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদী

মাকু শহরটি একটি টীলার ওপরে অবস্থিত। এই শহরটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। নদীটির নাম হচ্ছে যাংমর। নদীটির কারণে শহরটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মাকু শহরের ওপরে বিশাল বিশাল পাথর বা শীলার অস্তিত্ব থাকার কারণে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। নতুন নতুন দর্শনার্থী অর্থাৎ যাঁরা প্রথমবারের মতো এই শহরে যায় তাঁদের প্রথম দৃষ্টিতেই নজরে পড়ে প্রাচীন আমলে যুদ্ধের জন্যে নির্মিত প্রতিরক্ষা দূর্গ। শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিদর্শন প্রাচীন এই দূর্গটির কথা ভূগোলবিদ কিংবা পর্যটকগণও উল্লেখ করতে ভোলেন নি। খ্রিষ্ট্রিয় ১৪ শতাব্দিতে ইরানের বিশিষ্ট ভূগোলবিদ হামদুল্লাহ মোস্তাওফি তাঁর ‘নুযহাতুল কুলুব’ নামক বইতে এই মাকু শহর সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।

মাকু শহরে ঐতিহাসিক এবং পুরাতাত্ত্বিক যে সব নিদর্শন রয়েছে সেগুলো থেকেও সহজেই বোঝা যায় যে এই শহরটি কতো প্রাচীন। এসব নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখ করার মতো হচ্ছে ‘দোখমে সাঙ্গিয়ে ফারহদ’, বাংলায় এর অর্থ হবে ফরহাদ পাথুরে সমাধি। দোখমে হলো যরাথ্রুস্ট ধর্মাবলম্বীদের সমাধি। মাটির নীচে কক্ষ তৈরি করে এই সমাধি তৈরি করা হয়। সমাধিটির উপরে অর্ধেক চাঁদের মতো ছাদ থাকে। মাকু শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে এই সমাধিটি অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক অর্থাৎ উরা’তুহা’ শাসনামলের সমাধি বলে ইতিহাসবিদগণ অভিমত দিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে ‘দোখমে সাঙ্গিয়ে ফারহদ’ ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছে।

জাংমার নদী

‘দোখমে সাঙ্গিয়ে ফারহদ’ মূলত দুটি কক্ষমাত্র। কক্ষ দুটি একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া। আলাদা কোনো দরোজা নেই তবে দুই কক্ষেই যাওয়া আসা করা যায়। আর রুমগুলো তৈরি করা হয়েছে বিশাল পাথরের ভেতরে।  কক্ষ থেকে পাথরের একটি সিঁড়ি চলে গেছে পাহাড় পর্যন্ত। স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘ফারহদ দামু’ অর্থাৎ ফরহাদের ঘর। ফরহাদের ঘরের প্রবেশপথটির আকার হবে দৈর্ঘে দুই মিটার আর প্রস্থে এক মিটার। আর রুম দুটোর একটির আয়তন বারো বর্গমিটারের মতো আরেকটির আয়তন চার বর্গমিটার। রুমগুলোর দেয়াল কেটে কেটে তাক বানানো হয়েছে। এই তাকগুলো মশাল জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। সমাধিটির ভেতরের পরিবেশ বেশ সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন।

মাকু শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ‘বাগচে জুক’ গ্রামের পাশে একটি প্রাচীন প্রাসাদ রয়েছে। ‘বাগচে জুক প্রাসাদ’ নামেই এটি প্রসিদ্ধি পেয়েছে। প্রাসাদটির ঐতিহাসিক মূল্য যেমন রয়েছে তেমনি সৌন্দর্যের কারণেও এটি বেশ আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয়। কাজারি শাসনামলের শেষ দিকে অর্থাৎ বিশ শতকের শুরুর দিকে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে ঐতিহাসিক তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী মনে করা হয়। সুনসান একটি বাগানের মাঝখানে বাগচে জুক প্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছে। প্রাসাদের আয়তন দুই হাজার পাঁচ শ’ মিটার। আর বহিরাঙ্গনসহ পুরো এলাকার আয়তন এগারো হেক্টর। কাজারি শাসনামলের শেষ দিকে ঐতিহাসিক যেসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছিল সেগুলোর অন্যতম একটি নিদর্শন এই প্রসাদ কমপ্লেক্সটি। ১৮৭৪ সালে ইরান সরকার ঐ প্রাসাদটি কিনে নিয়ে ব্যাপক সংস্কার কাজ চালায়। এরপর ১৯৮৫ সালে সর্বসাধারণের দেখার জন্যে প্রাসাদটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারাও যদি দেখতে যেতে চান সমস্যা নেই, সাদরে বরণ করা হবে সবাইকে।

জাংমার নদীতীরে গীর্জা

মাকু শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে বিশাল বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে এবং আশেপাশের টীলাগুলোর ওপরে ‘তাতাউস মোকাদ্দাস’ নামে প্রাচীন একটি গির্যা রয়েছে। টীলাগুলোর পাশ দিয়ে খালের মতো জলের একটি ধারা বয়ে গেছে। যার ফলে এখানকার গির্যার সৌন্দর্যটা বেশ মোহনীয় হয়ে উঠেছে। গির্যাটির অবশ্য আরো একটি নাম আছে। সেটা হলো ‘কোররে  কিলিসা’। আর্মেনীয় খ্রিষ্টানদের কাছে এই গির্যাটি খুবই সম্মানীয় এবং মহাপবিত্র হিসেবে বিবেচিত। খ্রিষ্টিয় চল্লিশ সালে হযরত ইসা (আ) এর অনুসারী তাদিউস মোকাদ্দাস খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে এ এলাকা সফরে আসেন এবং দাওয়াতী কাজের মধ্য দিয়ে একদল লোককে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। কিন্তু আর্মেনীয় বাদশার রোষানলে পড়ে তাদিউসসহ তার একদল অনুসারী মারা যায়। জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে তারা মারা পড়েছিলেন। এ কারণে প্রতিবছর এ সময়টাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আর্মেনীয় খ্রিষ্টানরা এই গির্যা যিয়ারত করতে আসে। তারা এখানে সমবেত হয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।

পাঞ্জ চেশমে’ সেতু এখানকার আরো একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। মাকু শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে যাংমর নদীর উপরে সেতুটি নির্মিত হয়েছে। সাদা এবং কালো পাথর দিয়ে নির্মিত এই সেতুটির সৌন্দর্য যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তাতাউস গির্যা যিয়ারত করতে আসা লোকজন যাতে দ্রুত এবং সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে গির্যায় আসতে পারেন সে জন্যেই এই সেতুটি বানানো হয়েছে। ডক্টর উইলফ্রাম ক্লায়েস ১৯৮৬ সালে এই সেতুটির উল্লেখ করে বলেছেন সেতুটি অষ্টাদশ শতকের। আর্মেনীয়রা এটি নির্মাণ করেছেন।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি:৫০/অ:৫০/ই:৫০/২৯