সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৬ ১৯:২৯ Asia/Dhaka

 গত পর্বে আমরা ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আর্দেবিলে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। এই প্রদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথেও আমরা পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।তাই আজো আমরা এই প্রদেশেই বেড়াতে যাবো ইনশাআল্লাহ। তবে আজ দেখার চেষ্টা করবো এখানকার ঐতিহাসিক শহর আর্দেবিল।

বিশাল বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝখানে সাবালন এবং তালেশ পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে আর্দেবিল নামের ঐতিহাসিক এই শহরটি অবস্থিত। এই শহরটিতে প্রচুর পরিমাণ পানির সংকুলান রয়েছে। রয়েছে ঠাণ্ডা আবহাওয়া আর চমৎকার উর্বর মাটি। ভৌগোলিক পরিস্থিতির দিক থেকেও এই এলাকাটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এই এলাকার আবহাওয়া খুব বেশি গরমও নয় আবার খুব বেশি ঠাণ্ডাও নয়, মোটামুটি নাতিশীতোষ্ণ বলা যায়। আর সেজন্যেই এখানকার আবহাওয়াটা খুবই উপভোগ্য। হিজরি চতুর্থ শতকে লেখা একটি বইয়ের নাম ছিলো ‘হুদুদুল আলম’। এ বইটিতে আর্দেবিল শহর সম্পর্কে বলা হয়েছে আর্দেবিল একটি আবেস্তায়ি শব্দ। এই শব্দটি একটি যৌগিক শব্দ। ‘অরতা’ এবং ‘বিল’ এই দুটি শব্দের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে আর্দেবিল। আবেস্তায়ি ভাষার অরতা’ শব্দের অর্থ হলো পবিত্র আর বিল শব্দের অর্থ হলো বিন্যস্ত। এভাবে দুটি শব্দের মিশ্রণে গঠিত অরতা’বিল-এর অর্থ দাঁড়ালো পবিত্র এবং সুবিন্যস্ত শহর। কালের পরিক্রমায় এই অরতা’বিল শব্দটিই আর্দেবিল শব্দে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর্দেবিল প্রদেশের তালেশ এলাকায় যারা বসবাস করে তারা এখনো আর্দেবিলকে অর্দ্‌ভেইল বলে ডাকে যার অর্থ হলো পবিত্র এলাকা।

শেখ সাফিউদ্দিন আর্দেবিলির কবর

ইরানের আজারবাইজান এলাকায় ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহরের একটি হলো তাব্রিয, তারপরই হলো আর্দেবিলের স্থান। সুমেরিয়ানদের মাটির ফলকে আর্দেবিলের নামটি লেখা হয়েছে অরতা’ অথবা অরত্তা’ হিসেবে। সেই মাটির ফলক  থেকে আর্দেবিল শহরের প্রাচীনত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে। ঐতিহাসিকগণ বলেছেন শহরটি পাঁচ হাজার বছরের পুরণো। কোনো কোনো পুরাতাত্তিকও প্রাপ্ত অনেক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলেছেন আর্দেবিল অঞ্চলটিতে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দ থেকেই আবাসন বা জনবসতি গড়ে উঠেছে। পুরাতত্ত্ব বিজ্ঞানীগণ তাদের গবেষণার স্বার্থে এ এলাকায় বহুবার খনন কার্য চালিয়েছেন। বলা বাহুল্য মুরাদলু এলাকায় যেসব প্রস্তর লিখন আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলো থেকে চল্লিশ হাজার বছরের ইতিহাসের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সময়ের বিবর্তনে আর্দেবিল শহরের উপর দিয়ে বহু চড়াই উৎরাই বয়ে গেছে। বনী উমাইয়াদের শাসনামলে এই আর্দেবিল শহর ছিল আজারবাইজানের মূল প্রশাসনিক কেন্দ্র। কিন্তু ১১২০ খ্রিষ্টাব্দে এই শহরটিতে মোঙ্গলরা হামলা চালায়। যার ফলে শহরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খ্রিষ্টিয় ষোলো শতকে সাফাভি রাজবংশ শাসন ক্ষমতায় আসার ফলে আর্দেবিল শহরটি আবারো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে আপন মর্যাদা ফিরে পায়।

শেখ সাফিউদ্দিন আর্দেবিলির কবর কমপ্লেক্স

অপরদিক থেকে ইউরোপ এবং ইরানের সাথে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অন্যতম রুট হিসেবে এই সাফাভি শাসনামলেই  শহরটির গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সাফাভি শাসনামলের ঐতিহাসিক অনেক কীর্তি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেখ সাফিউদ্দিন আর্দেবিলির সমাধি স্থাপনাটি সে সময়কার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। সাফাভিয়ে রাজবংশের পতনের পর ঐতিহাসিক অনেক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আর্দেবিলের গুরুত্ব, মর্যাদা এবং চাকচিক্য কমতে শুরু করে। তবে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আর্দেবিল শহরটি পুনরায় সুগঠিত হয় এবং এই শহরটি আর্দেবিল প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহরে পরিণত হয়।

সাফাভি শাসনামলের ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন থেকেই প্রমাণিত হয় যে আর্দেবিল শহরটি বেশ পুরোণো এবং বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন। সে রকমই একটি নিদর্শন নিয়ে আমরা আসরের এ পর্যায়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। এই নিদর্শনটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নিদর্শনটি হলো শেখ সাফিউদ্দিন আর্দেবিলির জাঁকজমকপূর্ণ সমাধিস্থল। এখানে দাফন করা হয়েছে সাফাভি শাহদের পূর্বপুরুষ শেখ সাফিউদ্দিন আর্দেবিলিকে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে পড়েছে এই সমাধিস্থলটি। এই কবরস্থানটির সর্বপ্রথম ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল খ্রিষ্টিয় চৌদ্দ শতকে। তবে তার পর কালের পরিক্রমায় বিশেষ করে সাফাভি শাসনামলে এই সমাধি কমপ্লেক্সের সাথে আরো অনেক জায়গা যুক্ত করে স্থাপনাটির পরিসর বিস্তৃত করা হয়েছে। সে কারণেই এখন এতো দৃষ্টি নন্দন হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি।

টাইলসের কারুকাজ

বিশেষ করে ধর্মীয় স্থাপনার দিক থেকে অনন্য সাধারণ এই সমাধি কমপ্লেক্সটিতে বিভিন্ন যুগে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সমাধি। সর্বপ্রথম এই সমাধি স্থাপনাটিকে যিনি কমপ্লেক্সের রূপ দিয়েছিলেন তিনি হলেন শাহ তামস্ত্‌ সাফাভি। তার পর শাহ আব্বাস সাফাভি আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যুক্ত করেন এই কমপ্লেক্সে। সেইসাথে তিনি এই কমপ্লেক্সের অনেক সংস্কারও করেন। সাফাভি রাজবংশের অনুক্রমকি ধারাবাহিকতা প্রমাণের ক্ষেত্রেও এই সমাধি কমপ্লেক্সটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সাফাভি শাহগণ এবং একইভাবে শাহ ইসমায়িল প্রথমকেও এই সমাধি কমপ্লেক্সে দাফন করা হয়েছে। ইসলামী স্থাপত্যকলার দিক থেকেও এই স্থাপনাটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এই সমাধি কমপ্লেক্সের প্রতিটি স্থাপনাই কোনো না কোনো দিক থেকে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। কমপ্লেক্সটির সৌন্দর্য এবং লে-আউট ডিজাইন দেখার মতো। বলে কিংবা শুনিয়ে তার সৌন্দর্য বোঝানো দুরূহ একটি বিষয়। যাঁরা কৌতূহলী, তাঁদেরকেই অবশ্যই সুবিধামতো সময়ে একবার ঘুরে আসার আমন্ত্রণ রইলো।

শেখ সাফি উদ্দিন সমাধি স্তম্ভের মূল স্থাপনাটির ওপরে রয়েছে স্তম্ভের আকৃতির একটি টাওয়ার। ঐ টাওয়ারের ওপরে রয়েছে একটি গম্বুজ। এই গম্বুজের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আল্লাহ, আল্লাহ গম্বুজ’। সম্ভবত গম্বুজের বাইরের দিকটায় ফিরোযা রঙের টাইলস দিয়ে আল্লাহ আল্লাহ শব্দ কারুকার্যময় করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলেই এইরকম নামকরণ। ইটের পাটাতনের  ওপর টাইলসগুলো বসিয়ে কাজটা করা হয়েছে বেশ সুন্দর করে। এই টাওয়ার বা আল্লাহ আল্লাহ গম্বুজটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে প্রচণ্ড ভূমিকম্পেও বিশেষভাবে তা প্রতিরোধ করতে পারবে। ইতোমধ্যে বহুবার প্রচণ্ড ভূমিকম্প প্রতিরোধ করে এই গম্বুজ তার নিজস্ব অস্তত্ব যথাযথভাবে টিকিয়ে রেখেছে।

এই সমাধি কমপ্লেক্সে রয়েছে প্রয়োজনীয় আরো অনেক ধর্মীয় স্থাপনা। যেমন মহিলাদের অবস্থানের বা ইবাদাতের জন্যে নির্দিষ্ট স্থান। রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা দীক্ষার জন্যে নির্দিষ্ট স্থান। যেখানে ছাত্ররা কুরআন মুখস্থ করে হাফেজে কুরআন হয় এবং রয়েছে মাদ্রাসাও। এই মাদ্রাসায় ছাত্ররা কুরআনের তাফসিরসহ হাদিস এবং ইসলামী বিধি বিধানের শিক্ষাগুলোসহ প্রয়োজনীয় আরো অনেক ইসলামী জ্ঞান অর্জন করে।

সমাধিটির নির্মাণ এবং স্থাপত্যশৈলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। স্থপতিদের মেধায় সহজেই এই স্থাপনাটি যুক্ত করতে পারে নতুন নতুন চিন্তা এবং আইডিয়া।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৫