সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৬ ১৫:৫৫ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আর্দেবিলে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। বেড়াতে বেড়াতে আমরা দেখেছিলাম এখানকার ঐতিহাসিক অনেক নিদর্শন। ঐতিহাসিক ঘরদোর, মসজিদ, সমাধিস্থল, ঐতিহাসিক গোসলখানা, সরাইখানা, ব্রিজ ইত্যাদি সবই আর্দেবিল শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। আমরা এগুলোর কোনো কোনোটির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টাও করেছি। তবে আজকের আসরে প্রাচীন আর্দেবিল শহরের পর্যটক আকর্ষণীয় কিছু স্থাপনার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।

আর্দেবিল জুমা মসজিদ দিয়েই শুরু করা যাক। এই মসজিদটি আর্দেবিল শহরের উত্তর পূর্ব দিকে প্রাচীন একটি টিলার ওপরে অবস্থিত। সেলজুকি শাসনামলে এই বিশাল মসজিদটি নির্মাণ করা হয় এবং ইসলামের বিভিন্ন যুগপর্বে অনন্য সাধারণ এই মসজিদটির সংস্কার করা হয়। এভাবে মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে এসেছে সাফাভি শাসনামলের শুরুর দিক পর্যন্ত। এ অঞ্চলে সর্বশেষ যে খননকাজটি পুরাতাত্ত্বিকগণ পরিচালনা করেছিলেন, সেইসব গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে আর্দেবিল জুমা মসজিদটি সম্ভবত সাসানীয় যুগের সাথে সম্পৃক্ত একটি স্থাপনার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটির মূল ফাউন্ডেশান বা ভিতটা হলো চারটি খিলানযুক্ত বারান্দা এবং গম্বুজ। পুরো স্থাপনাটিই ইটের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে টাইলসেরও কারুকাজ লক্ষ্য করা যায় যদিও পরিমাণে খুবই কম।

সুপ্ত আগ্নেয়গিরি পর্বত সাবালান,আরদেবিল

জুমা মসজিদের বিরাট একটি শাবেস্তান অর্থাৎ ছাদযুক্ত উন্মুক্ত বারান্দা বা আঙ্গিনা রয়েছে। এই শাবেস্তানেই রয়েছে মসজিদটির মূল মেহরাব। মসজিদের মূল অডিটোরিয়ামের নীচে বেশ কয়েকটি প্যাসেজ রয়েছে লোকজনের যাওয়া আসা করার জন্যে। অত্যন্ত সুশৃঙ্ক্ষলভাবে এগুলোকে বিন্যস্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর্দেবিল জুমা মসজিদটির মূল শাবেস্তানের বাইরের অঙ্গনে একটি মিনারও রয়েছে। মসজিদের পশ্চিম দিকটাতে নির্মিত ঐ মিনারটি দেখতেও বেশ সুন্দর। সেলজুকি শাসনামলে এই মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। এর কারণটা হলো মিনারে যেসব কারুকার্য করা হয়েছে সেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় এগুলো সেই সেলজুকি শাসনামলের কাজ। মসজিদের শাবেস্তান থেকে পশ্চিম দিকে নির্মিত এই মিনার পর্যন্ত দূরত্বে বড়ো বড়ো পিলারের ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়।

আর্দেবিলের প্রাচীন জামে মসজিদ

এগুলো থেকে এই মসজিদটির প্রাচীনত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে সহজেই। এইসব প্রমাণপঞ্জি আর্দেবিল জুমা মসজিদটির প্রাচীনত্বকেই ফুটিয়ে তোলে। এই প্রাচীনত্বের কারণে পুরাতত্ত্ব গবেষকদের দৃষ্টি পড়েছে এই মসজিদ স্থাপনাটির ওপর। ইসলামী যুগের মসজিদ স্থাপনার মধ্যে আর্দেবিল জুমা মসজিদটিকে বিরল একটি নিদর্শন বলে মনে করা হয়। ইলখানি, সেলজুকি, সাফাভি এবং কাজারি শাসনামলসহ বিভিন্ন সময়ে এই মসজিদ স্থাপনাটির মেরামত করা হয়েছে। ১৯৩৬ সালে এই মসজিদটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকার অর্ন্তভুক্ত হয়েছে।

আর্দেবিল শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো এই শহরটির বাজার কমপ্লেক্স। সিল্ক রোডের মধ্যে শহরটির অবস্থানের কারণে এবং গিলানে উৎপাদিত সিল্ক পণ্য এ অঞ্চল থেকে ইউরোপে সরবরাহ করার কারণে সেই প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যি কেন্দ্র হিসিবে আর্দেবিল বাজার কমপ্লেক্সটির ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। ফরাশি ভূবন পর্যটক ‘তাভেরনিয়া’ আর্দেবিলে সিল্ক বাণিজ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে লিখেছেনঃ “সিল্ক বাণিজ্যের কাফেলা-যা কিনা কখনো কখনো আট শ উট থেকে নয় শ উট পর্যন্ত হতো-এই শহরের খ্যাতি বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। গিলানের প্রতিবেশি যেসব এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে সিল্ক পণ্য আসে যেমন ককেশাসের অন্তর্ভুক্ত শামাখি, সেইসব এলাকার সিল্ক পণ্যগুলো আর্দেবিল শহরের মধ্য দিয়েই ইস্তাম্বুল এবং আযমিরে যায়। এই বিশাল কাফেলা আর্দেবিল শহর হয়ে যাবার কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই শহরটি বাণিজ্যিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই গুরুত্বের কারণেই তাব্রিয শহরের মতো এই শহরেও সর্বপ্রকার মালামাল সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।

আর্দেবিলের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাজার

আর্দেবিল বাজারটিকে সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্যরীতির নিদর্শন বলে ধরা হয়।আর্দেবিল শহরের ঠিক মাঝখানে পড়েছে এই বাজারটি।নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে বাজারটিতে। হিজরি সপ্তম এবং অষ্টম শতকে এই বাজারটির ব্যাপক সুনাম সুখ্যাতি ছিল।তবে বছর পঞ্চাশেক আগে বাজারের প্রাচীন কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে।আগেকার ডিজাইনে বাজারের এক প্রান্ত থেকে অপর যে কোনো প্রান্তের যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল।কিন্তু পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু দিক ধ্বংস হয়ে যায় এবং কোনো কোনো অংশ মূল বাজারের কাঠামো থেকে আলাদা হয়ে যায়।বাজারের ছাদে স্থান বিশেষে গম্বুজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এইসব গম্বুজের সাহায্যে বাজারের ভেতরে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাফাভি এবং কাজারি যুগের বাজারগুলোর ডিজাইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম।১৯৮৫ সালে ঐতিহাসিক এই বাজার কমপ্লেক্সটিকে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এর ঐতিহাসিক মূল্য বা মর্যাদা ব্যাপক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।এই কারণেই এ সময় থেকে বাজারটির মৌলিক সংস্কার ও পুনর্নিমাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

সাফাভিয়ে শাসনামলের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো শায়খ আমিনুদ্দিন জিব্রাইলের কবর।ইরানের ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম একটি নিদর্শন কবরস্থানের বিস্তীর্ণ নমুনার সবোর্ত্তম উদাহরণ হিসেবে মনে করা হয় এই কবরস্থানটিকে।ডিজাইন বা স্থাপত্যশৈলী কিন্তু একেবারেই সহজ সাধারণ। তবে ভেতরে বাইরে কারুকাজ করা হয়েছে বেশ সুন্দর করে।এই সৌন্দর্যের কারণে এই স্থাপত্য নিদর্শনটিকে সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্যকলার একটি মাস্টারপিস বলে মনে করা হয়।

আর্দেবিলের ঐতিহাসিক এইসব নিদর্শনের পাশাপাশি এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয়টি উল্লেখ না করলে বর্ণনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পার্বত্য সৌন্দর্যের লীলা বৈচিত্রময় এই এলাকাটি পর্বতারোহীদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত এবং প্রিয়,প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছেও ঠিক সেরকমই।এখানকার সাবালন পর্বত চূড়াটি ইরানের দ্বিতীয় সবোর্চ্চ পর্বতচূড়া। এর উচ্চতা চার হাজার আট শ মিটার।প্রতি বছর বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে হাজার হাজার পর্বতারোহী এখানে আসে।

সাবালনের অন্তরে ঘুমিয়ে আছে ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি।পর্বত চূড়ায় যে বরফ জমে সেই বরফ চুঁইয়ে চুঁইয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পাশেই জন্ম দিয়েছে একটি হ্রদের।ঠাণ্ডায় এই বরফ জমা হ্রদ-যাকে প্রাকৃতিক হিমাগার বলাই ভালো-এটি গরমের সময় গলে পড়ে।চূড়া থেকে বরফ গলা পানি নীচে পড়ে জন্ম দিয়েছে নদীর। বরফ গলা নদী। কতোটা স্বচ্ছ এ পানি একবার ভেবে দেখুন।এই স্বচ্ছতোয়া ফটিক জলের ওপর যদি প্রাকৃতিক সবুজ আর নীল আকাশের প্রতিচ্ছায়া পড়ে দেখতে কেমন ছবির মতো দেখাবে-ভাবুন। বরং না ভেবে দেখেই আসার চেষ্টা করুন একবার।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি:৫৩/অ:৫৩/ই:৫৩/৬