রংধনু আসর : মক্কায় ইরানি হাজিদের ওপর হামলার বার্ষিকী
পবিত্র ঈদ-উল-আজহার সাথে জড়িয়ে আছে পবিত্র হজ। আর হজের একটি আনুষ্ঠানিকতা হলো কোরবানি। হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত এই পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। কুরবানির গোশত নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি দুঃস্থ, দরিদ্র-অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ পান তারা। ঈদের দিন মেহমানদারির ধুম পড়ে যায়। মেহমানদের কিভাবে খুশি করা যায় তা নিয়ে মানুষের চেষ্টার যেন শেষ নেই।
তবে, এমন কিছু মানুষ আছেন যাদেরকে ঈদ তথা হজের সময় স্ময়ং মহান আল্লাহতায়ালা মেহমানদারি করার ঘোষণা দিয়েছেন। তোমরা শুনে বিস্মিত হলেও মহান আল্লাহ সৌভাগ্যবান মেহমান হচ্ছেন হাজিরা। তারা যতদিন হজের জন্য মক্কা-মদীনায় থাকবেন ততদিন তারা আল্লাহর মেহমান হিসেবে বিবেচিত হবেন।
হজ করার জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ যেহেতু সৌদি আরবে যান সেহেতু তাদের নিরাপত্তা ও সুন্দরভাবে ইবাদতের সুযোগ করে দেয়ার দায়িত্ব রিয়াদ সরকারের। কারণ হাজিদের মেহমানদারির দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে সৌদি আরব। তারা যদি আল্লাহর মেহমান হাজিদের প্রতি ভালো ব্যবহার করে, তাদেরকে আদর আপ্যায়ন করেন তাহলে আল্লাহ খুশি হবেন। তার পরিবর্তে যদি হাজিদের ওপর জুলুম করে, তাদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করে তাহলে মুসলিম উম্মাহ এবং মহান আল্লাহর কাছে তারা দায়ী থাকবে।
২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মিনায় শয়তানের প্রতীকে পাথর নিক্ষেপের অনুষ্ঠানে সৌদি কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে হাজার হাজার হাজি নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে ইরানি হাজিই ছিলেন প্রায় পাঁচশ। একই বছর মসজিদুল হারামের ওপর ক্রেন ভেঙে ১১ ইরানিসহ মোট ১০৭ জন নিহত হন। এই দুটি ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করায় সৌদি সরকার ইরানিদের হজ করার ওপর বেশি কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। পাশাপাশি তারা ইরানি হাজিদের পর্যান্ত নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করে। এ কারণে ইরান সরকার ২০১৬ সালের হজ বর্জন করেছে।
হজের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রেরণা লাভ করা। ইমাম সাদেক (আ.) এ সম্পর্কে বলেছেন, ''ইসলাম হজের মাধ্যমে এমন একটি বিধান দিয়েছে যার ফলে প্রাচ্যের মানুষ বলুন আর পাশ্চাত্যের মানুষই বলুন সবাই একত্রিত হতে পারে এবং পরস্পরের সাথে পরিচিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে।" হজ কেবল ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীকই নয়, এটা হচ্ছে শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি প্রেরণার নাম। হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো, প্রতীকী শয়তানকে পাথর মারা। হজের এ শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৪০৭ হিজরীর ৫ জিলহজ শত শত ইরানি হাজি সৌদি পুলিশের হামলায় শাহাদতবরণ করেন। আমেরিকা ও ইসরাইলের ইন্ধনে সৌদি সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী বিনা উস্কানীতে সেদিন অন্ত ৫০০ ইরানি হাজিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় প্রায় সাড়ে ছয়শত হাজি আহত হন।

পবিত্র কাবাঘর হচ্ছে আল্লাহর পক্ষে থেকে ঘোষিত সর্বাপেক্ষা শান্তিময় ও নিরাপদ স্থান। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় বলেছেন, 'হজের সময় ব্যাভিচার, অশ্লীলতা, খোদাদ্রোহিতা, ফাসেকী কাজ এবং ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা যাবে না।"
মূলত হাজিরা যাতে নিরাপদে হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে পারেন সে জন্যই মহান হজের সময় ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু আল্লাহর এ নিষেধ অমান্য করে ১৯৮৭ সালে আমেরিকার নির্দেশে সৌদি সরকার ইরানি হাজিদের ওপর গণহত্যা চালায়। তাদের এ হত্যাযজ্ঞ থেকে নারী, পঙ্গু ও বৃদ্ধ হজযাত্রীরাও রেহাই পায়নি। এখন আমরা সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করব।
১৪০৭ হিজরীর ৫ই জিলহজ অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই, রোজ শুক্রবার। জুমআর নামাযের আগে আগে সেদিন লক্ষাধিক ইরানি হাজিসহ অন্যান্য দেশের হজযাত্রীরা ঐতিহাসিক মক্কা নগরীতে এক মিছিলের আয়োজন করে। মিছিলকারীরা যে সব শ্লোগান দেয় সেগুলো হচ্ছে, 'আল্লাহু আকবার', 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, 'আমেরিকা আল্লাহর দুশমন', 'ইসরাইল আল্লাহর দুশমন' 'বিশ্বের সকল মুসলিম এক হও', 'আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে' ইত্যাদি। এই মিছিলে সৌদি আরব কিংবা সৌদি রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে একটি শ্লোগানও দেয়া হয়নি। কিন্তু তারপরও মিছিলটি যাত্রা শুরু করার সাথে সাথে সৌদি পুলিশের ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। মিছিলকারীদের কেউ কেউ পবিত্র কা'বা ঘরে আশ্রয় নিতে চাইলেও পুলিশ তাদেরকে সেখানে যেতে দেয় নি। ফলে রাস্তার ওপরই হাজিরা সৌদী নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার শিকার হন। পুলিশের গুলি ও গ্যাস নিক্ষেপের ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রায় ৫০০ হজযাত্রী শহীদ হন।
নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি সরকার শহীদদের লাশ ফেরত দিতে গড়িমসি করে। শহীদদের লাশ আনার জন্য ইরানের একটি বিমান সৌদি আরবে পাঠানো হয়। বিমানটি মক্কা বিমান বন্দরে ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করে মাত্র ৪০ জন শহীদের লাশ নিয়ে ফিরে আসে। এরপর ইরান সরকার আরো একটি বিমান পাঠায়। সৌদি সরকার আহত হজযাত্রীদের ন্যূনতম চিকিৎসা দিতেও রাজি হয়নি। এর ফলে বহু আহত হাজি বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এছাড়া দশজন হাজিকে জেলখানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালানো হয়।
হজের সময় পবিত্র মক্কা নগরীতে সৌদি সরকারের অমানবিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকার, ইসলামী সংগঠন, রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী মহল ও আলেম-ওলামাগণ তীব্র নিন্দা জানালেও সৌদি আরবের মিত্র আমেরিকা বলেছে, এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া নাকি সৌদি সরকারের অধিকার! দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদি ইসরাইল হত্যাকাণ্ডের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। এসব দেশের প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝা যায়, সৌদি আরবের ওহাবী শাসকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলী কুফরী শক্তির সাথে মিলে ইসলামের প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।

হজযাত্রীদের ওপর এ হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং ওই পরিকল্পনার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত ছিল। মক্কার সাপ্তাহিক 'আলম আল ইসলামী পত্রিকায় এ সম্পর্কে লেখা হয়, ৩১ জুলাইয়ের রক্তাক্ত ঘটনার নীলনকশা তৈরি করা হয় মার্কিনীদের ইচ্ছা অনুযায়ী এবং এ ব্যাপারে সৌদি ও মার্কিন সরকারের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতাও হয়। এছাড়া সৌদি আরবে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ হামলার পরিকল্পনার ব্যাপারে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেন। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ.) তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, “আমরা কুদস সমস্যাকে চেপে যেতে পারি, সাদ্দামকে অবজ্ঞা করতে পারি, যারা আমাদের ক্ষতি করেছে, তাদের ক্ষমা করে দিতে পারি; কিন্তু মক্কার ঘটনাকে কিছুতেই খাটো করে দেখতে পারি না।” তিনি আরো বলেন, “মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থান মক্কার মর্যাদা এইভাবে ক্ষুণ্ন করা হবে আর মুসলমানরা চুপ করে থাকবে তা হতে পারে না।”
পবিত্র কা'বা শরীফ হচ্ছে সমগ্র মুসলিম জাতির সম্পদ। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র ও নিরাপদ স্থান। অথচ সৌদি শাসকরা আল্লাহর এ ঘরের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। কেবল নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা তাদের মার্কিন প্রভুদের খুশি করার জন্য কাবা ঘরের মেহমান সম্মানিত হাজিদের ওপর হামলা করেছে। তাদের ষড়যন্ত্র ও দায়িত্বহীনতার কারণে প্রায় প্রতিবছরই শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের জীবন দিতে হচ্ছে।
বিশ্বের কোনো মুসলমানই চায় না, কাবাঘর আবার রক্তে রঞ্জিত হোক। কেবল হজের মওসুম নয়, যেকোনো সময় কাবা শরীফ মুসলমানদের নিরাপদ স্থান হিসেবে পরিচিত হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা এটাই।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৮