অক্টোবর ০৯, ২০১৬ ১৮:৪৫ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম সম্পর্কে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে মো: মুনীর হোসাইন খান। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও উপস্থাপনায়: নাসির মাহমুদ

রেডিও তেহরান: মহররম মাসে সংঘটিত কারবালার ব্প্লিব, স্থান, কাল ও ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক বিশ্বজনীন বার্তা তুলে ধরে মানবজাতির কাছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির আলোকে এই বিপ্লব মুসলমানদের কাছে কী প্রত্যাশা করে?

মো: মুনীর হোসাইন খান: কারবালায় ইমাম হোসাইনের (আ.)কালজয়ী সুমহান এ বিপ্লব বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির আলোকে মুসলমানদের কাছে প্রত্যাশা করে তাদের হোসাইনী হয়ে ইমাম হোসাইনের(আ.) সুমহান সংগ্রাম, ত্যাগ ও কোরবানি অর্থাৎ জিহাদ ও শাহাদাতের আদর্শকে বহন করে যুগের ইয়াজিদ,সীমার,ইবনে জিয়াদদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। আজ যুগের ইয়াজিদ, সীমার, ইবনে জিয়াদরা হচ্ছে ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স তথা পাশ্চাত্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের তাবেদার বশংবদ গোলাম সৌদি-রাজবংশ, পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর রাজা-বাদশাহগণ  এবং সালাফী ওয়াহাবী তাকফিরি গোষ্ঠীসমূহ যেমন: দায়েশ(আইএস), আল-কায়েদা, তালেবান ইত্যাদি। যুগের এসব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইয়াজিদ, সীমার, ইবনে জিয়াদদের খুব ভালোভাবে চিনতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইনের শিক্ষা ও আদর্শের অনুপ্রেরণা নিয়ে আদর্শবাদী সংগ্রাম চালাতে হবে। লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলন এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকারী সংগ্রামীদের সমর্থন দান এবং বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও মুস্তাযআফদের পক্ষে যেমন : মজলুম ইয়েমেনের পাশে দাঁড়িয়ে একালের বনূ উমাইয়া ও ইয়াজিদীদের আধুনিক সংস্করণ বিধর্মী খ্রিষ্টান মার্কিন ও পাশ্চাত্যের পদলেহী ওয়াহবী সৌদি সরকারের বর্বর আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানানো উচিৎ। আজ নিঃসন্দেহে সৌদি সরকারকে যুগের হারমালা বলা যায়। কারণ, গত দেড় বছরেরও অধিক কাল ধরে তারা ইয়েমেনে নির্বিচারে বিধর্মী খ্রিষ্টান পাশ্চাত্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও বিমান দিয়ে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে হাজার হাজার মুসলমান নরনারী ও শিশুকে হত্যা করে যাচ্ছে। আর কারবালায় পাপিষ্ঠ হারমালাও ইমাম হোসাইনের (আ.) ছয়মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশু আলীআসগরকে তিনমাথা বিশিষ্ট তীর নিক্ষেপ করে শহীদ করেছিল ঐ সময় যখন ইমাম হোসাইন (আ.)তীব্র তৃষ্ণার্ত এই সন্তানকে নিয়ে এসে শক্রদের সামনে পানি চেয়েছিলেন। ঐ তিন মাথা বিশিষ্ট তীর শিশু আলী আসগরের কচি গলাকে এমনভাবে ছিন্নভিন্ন করেছিল যেন তাকে জবাই করা হয়েছে।

রেডিও তেহরান: বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের মত দেশগুলোতে, জনগণ দৃশ্যত ব্যাপক ধর্ম-কর্মে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতি, সহিংসতা ও নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়ের যে চিত্র দেখা যায় তার প্রেক্ষাপটে আশুরার শিক্ষার বাস্তবায়ন এ অঞ্চলের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক বা জরুরি হতে পারে?

মোঃ: মুনীর হোসাইন খান: আশুরার মহান বিপ্লব হচ্ছে আসলে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন্ত বাস্তব চিত্র ও নমুনা, যা ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর আহলুল বাইত (আ.) ও সংগীসাথীরা কারবালায় খুবই নিপুণ শৈল্পিক দক্ষতা সহকারে অংকন ও উপস্থাপন করেছিলেন। সত্য-মিথ্যা, হক ও বাতিলের মধ্যকার চির শাশ্বত সংগ্রামের এক চূড়ান্ত বাস্তব রূপ প্রকাশিত হয়েছিল আশুরার দিবসে কারবালায় যার সত্য পক্ষ ছিলেন স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর আহলূল বাইত ও সংগীসাথীর। আর মিথ্যা পক্ষ ছিল ইয়াজিদ, ইবনে মারজানা (উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ইবনে আবিহ), উমর ইবনে সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, সীমার প্রমুখ। ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে ঐদিন যারা অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করেছিল তাদের উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, ব্যাভিচারিতা, লাম্পট্য, দুর্নীতি পরায়নতা, পাপাচার, পাশবিকতা, হিংস্রতা, অসভ্যতা, দয়াময়-হীনতা, পশুত্ত্ব, সত্যকে ঘৃণা করা, মিথ্যাকে ভালবাসা এবং হারাম খাওয়া। ইমাম হোসাইন তাদেরকে লক্ষ্য করে একটি কথা বলেছিলেন যার মূল সারবত্তা হলো," তোমরা আমার বিরুদ্ধে না হক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছ এ কারণে যে তোমরা হারাম দিয়ে তোমাদের উদর পূর্তি করেছ অর্থাৎ হারাম খেয়ে তোমাদের হাড়গোড়  ও মাংস হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে"। আর হারাম খাওয়া যেমন মদ্যপান ও নিষিদ্ধ খাবার যেমন শুকরের মাংস ভক্ষণকেও শামিল করে ঠিক তেমনি ঐ হালাল খাবারকেও শামিল করে যা অন্যায়ভাবে ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থাৎ হারাম অবৈধ পন্থায় অর্জিত হয়েছে। সুতরাং ইমাম হোসাইনের খাঁটি অনুসারী হতে হলে সত্যিকার অর্থে আমাদের সবাইকে হোসাইনি হতে হবে অর্থাৎ সবধরনের দুর্নীতি,পাপাচার, নৈতিক, চারিত্রিক, অবক্ষয় থেকে অবশ্যই মুক্ত হতে সত্যকে ভালবাসতে এবং মিথ্যাকে ঘৃণা করতে হবে। আর নিজ জীবনে নীতি-নৈতিকতা ও দ্বীনে ইসলামের সুমহান শিক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন কখনোই সমাজকে দুর্নীতি, সহিংসতা ও নৈতিক চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করবে না। তাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান-ভারতের মত দেশগুলোতে জনগণ দৃশ্যত ব্যাপক ধর্ম-কর্মে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যাপক দুর্নীতি, সহিংসতা ও নৈতিক চারিত্রিক অবক্ষয় আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা আসলে ইসলামের সুমহান শিক্ষার সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই। আর ইমাম হোসাইন (আ.) যেমন নিজেও ছিলেন পূর্ণাঙ্গ ইসলামের জীবন্ত বাস্তব নমুনা এবং তিনি তার নিজ জীবনেও করেছিলেন ইসলামের পূর্ণ বাস্তবায়ন যে কারণে তাঁকে ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইমাম হাসান (আ.) কে বেহেশতের যুবকদের নেতা এবং তাদের মাতা হজরত ফাতিমা (আ.) কে বলা হয় বেহেশতের নারীদের নেত্রী। আসলে কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)এর বিপ্লব অর্থাৎ হোসাইনি আদর্শ ইসলামের কোন খণ্ডিত আংশিক অপূর্ণাঙ্গ রূপের উপস্থাপন নয় বরং তা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ খাঁটি তৌহিদি মুহাম্মাদী ইসলাম। কারবালার শাশ্বত চিরন্তন শিক্ষা ও আহবানই হচ্ছে এই খাঁটি, নির্ভেজাল তৌহিদি মুহাম্মাদী ইসলামের পূর্ণাঙ্গ  বাস্তবায়নের আহবান। আশুরা আন্দোলনের এক অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ তাই আমাদের সমাজকে দুর্নীতি, অন্যায়, সহিংসতা ও নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে আমাদের অবশ্যই ইসলামের এক অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিধান অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ বাস্তবায়ন করতেই হবে যা বর্তমানে সঠিকভাবে করা হচ্ছে না বলেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান-ভারতের মত দেশগুলোতে তথা সমগ্র বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি, অন্যায়, সহিংসতা ও নৈতিক চারিত্রিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করছি।

রেডিও তেহরান: পাশ্চাত্যের এবং আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় আশুরার চেতনা ও শিক্ষার সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে?

মো: মুনীর হোসাইন খান: পাশ্চাত্যের এবং আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় আশুরার চেতনা ও শিক্ষার সম্ভাব্য ভূমিকা বলব না বরং বলতে চাই আশুরার চেতনা ও শিক্ষার সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত ভূমিকা রয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, এ চেতনা ও শিক্ষা আমাদেরকে অর্থাৎ মুসলমানদেরকে এসব আগ্রাসনের মোকাবেলায় কার্যত: যেমন আত্মিক, আদর্শিক ও আধ্যাত্মিকভাবে উজ্জীবিত বলীয়ান, শক্তিশালী ও দৃঢ়পদ করবে ঠিক তেমনি যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক-ভাবেও আমাদেরকে ধৈর্যশীল, শক্তিশালী ও দৃঢ় করবে। ইমাম হোসাইনের বিপ্লব অর্থাৎ আশুরার আদর্শ, চেতনা ও শিক্ষার দুটো দিক আছে। যথা এক: আবেগগত দিক  এবং দুই: যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক। আর আশুরার দিবসে কারবালায় এদুটো দিকের সফল ও সার্থক সমন্বয় হয়েছিল বলেই আমরা দেখতে পাই মহাবীর হুর ইবনে ইয়াজিদের মত ব্যক্তিত্বও প্রায় ৩২/৩৩জন লোক শত্রু শিবির থেকে ইমাম হোসাইন (আ.)'র পক্ষে যোগ দিয়ে ইমামের পথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাৎ বরণ করেছেন আশুরার দিবসে। মিথ্যা বাতিল ইয়াজিদী পক্ষ ত্যাগ করে সত্য পক্ষ অর্থাৎ ইমাম হোসাইনের পক্ষে যোগ দিয়ে সত্যের পথে যুদ্ধ করে শাহাদাৎ বরণ করেছেন এবং ইমাম হোসাইনের (আ.) আহলে বাইত এবং সঙ্গিসাথিরাও শক্র পক্ষের বিপুল সংখ্যাধিক্য ও চরম নৃশংসতা এবং নিজেদের নিশ্চিত মৃত্যুবরণের কথা জেনেও দৃঢ় পদ থেকে সত্যের জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। ধৈর্য ব্যতীত কোন আন্দোলন ও সংগ্রামই সফল হয় না। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সফল মোকাবেলা করতে হলে অশেষ ধৈর্যেরও প্রয়োজন। কারবালার চেতনা ও শিক্ষা আসলে চরম সংকট ও বিপদসংকুল অবস্থায় ধৈর্যধারণ ও মহান আল্লাহর উপর ভরসা করার চরম শিক্ষা দেয়। আর তাই এ চেতনা ও শিক্ষা বাস্তবায়িত হলে আমরা অবশ্যই পাশ্চাত্যের এবং আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চরম ধৈর্যের সাথে সার্থকভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। তাই শত্রুপক্ষ সবসময় চেষ্টা করছে মুসলমানদেরকে বিশেষ করে যুব সমাজকে এ চেতনা, আদর্শ ও শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে। আমাদের উচিৎ কারবালার এ চেতনা, আদর্শ ও শিক্ষাকে তরুণ যুব সমাজের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রসার, প্রচার ও প্রচলন করা।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৯

 

ট্যাগ