জানুয়ারি ২৯, ২০১৭ ২০:৪৫ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের আলোচনায় আমরা সুরা মারিয়ামে উল্লেখিত নবী-রাসূলের জীবন-কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে কথা বলেছি। পরকাল ও তাওহিদ সুরা মারিয়ামের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়।

সুরা মারিয়ামের ৬৬ নম্বর আয়াতসহ কয়েকটি আয়াতের শানে নজুল সম্পর্কে বলা হয়:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র জামানায় এক মুশরিক মানুষের একটি পুরণো  পঁচা হাড় হাতে নিয়ে তা গুড়ো করে বাতাসের মধ্যে ছেড়ে দেয়। হাড়ের গুড়োগুলো নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সে বিদ্রূপ করে বলতে থাকে: মুহাম্মাদকে দেখুন! তিনি ভাবছেন যে মৃত্যুর পর আমাদের হাড় এভাবে পঁচে যাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমাদের আবারও জীবিত করবেন! এ ধরণের কিছু ঘটা এক অসম্ভব ব্যাপার! এ অবস্থায় নাজিল হয় সুরা মারিয়ামের ৬৬ নম্বর আয়াতসহ কয়েকটি আয়াত। এ সম্পর্কে ওইসব আয়াতে প্রশ্ন করে মহান আল্লাহ বলছেন:  

'মানুষ বলে: আমার মৃত্যু হলে  এরপর আমি কি জীবিত অবস্থায় কবর থেকে পুনরুত্থিত হব? মানুষ কি এই বাস্তবতা স্মরণ করে না যে, আমি তাকে এর আগে সৃষ্টি করেছি এবং সে তখন কিছুই ছিল না।'

অর্থাৎ যে আল্লাহ মানুষকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন অনস্তিত্ব থেকে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর তাকে কি আবারও জীবিত করতে সক্ষম নন? বুদ্ধি ও বিবেক-সম্পন্ন মানুষ এ ধরনের প্রশ্নের ব্যাপারে কখনও উদাসীন হতে পারে না এবং এ প্রশ্নের উত্তর যে ইতিবাচক তা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। যে মহান আল্লাহ মানুষকে একবার বা প্রথমবার অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন তিনি ইচ্ছে করলে যে বার বার ধ্বংসের পরও তাদেরকে আবার অবিকল আগের মতই মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করতে সক্ষম তা সুস্থ বিবেকের অধিকারী যে কোনো মানুষেরই  তা বোঝা উচিত। আর তা না হলে মানুষ নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য বুঝতে সক্ষম হবে না।   

কুরআনের অন্য অনেক আয়াতের মত এই আয়াতও পরকালের সঙ্গে সম্পর্কিত। পরকালে মানুষের শারীরিক পুনরুত্থানই ঘটবে। মানুষের পুনরুত্থান যদি শুধুই আত্মিক হত তাহলে কুরআনে তা বলা হত এবং পঁচে যাওয়া হাড় থেকে মানুষের পুনরায় জীবিত হওয়া সম্ভব কিনা সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ারই দরকার মনে করতেন না মহান আল্লাহ।

সুরা মারিয়ামের শেষের দিকের আয়াতে আবারও তাওহিদ বা একত্ববাদ সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহর সন্তান আছে- এমন ধারণা শিরক বা অংশীবাদের অন্যতম শাখা।

যেমন, মুশরিকরা বলত ফেরেশতারা হচ্ছে আল্লাহর কন্যা! আর বিভ্রান্ত বা জ্ঞানপাপী ইহুদিরা বলত উজাইর নবী (আ) আল্লাহর ছেলে! আর পথভ্রষ্ট খ্রিস্টানরা মনে করে হযরত ঈসা (আ) আল্লাহর পুত্র!  মহান আল্লাহ সম্পর্কে এমনসব হীন ও নীচ ধারণা তাওহিদ বা একত্ববাদের মূলনীতির বিরোধী।

কারণ, মহান আল্লাহর সমতুল্য ও সদৃশ কিছুই নেই এবং তাই আল্লাহ কখনও সন্তানের মুখাপেক্ষী নন।

এক সময় মানুষের আয়ু বা হায়াত শেষ হয়ে যায় বলে তার বংশধর থাকা জরুরি। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের শক্তি যখন কমে আসে তখন সে একজন সাহায্যকারী চায় এবং একাকীত্বকেও ভয় করে। তাই এ সময় সে প্রিয়জনের সান্নিধ্য কামনা করে। কিন্তু সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এই চাহিদা অর্থহীন। কারণ, মহান আল্লাহর ক্ষমতা সীমিত নয় এবং তাঁর অস্তিত্ব বা আয়ু সসীম নয়। তিনি কখনও একাকীত্ব, দুর্বলতা ও নির্জীবতা অনুভব করেন না।

 এ ছাড়াও সন্তানের অধিকারী হওয়ার জন্য শরীর ও স্ত্রী থাকা জরুরি। আর এই সবই  মহান আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

একত্ববাদ তথা এক আল্লাহর অস্তিত্ব অন্য সব অস্তিত্বের ভিত্তি। তাই মহান আল্লাহর সন্তান থাকার অভিযোগ বা অপবাদ এতটাই অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন যে বিশ্বের সব সৃষ্টি যেন এই অযৌক্তিক দাবির বিষয়ে আতঙ্কিত। তাই এ ধরনের কথা যে কতটা কদর্য ও অশ্লীল কুরআনে মহান আল্লাহ সুরা মারিয়ামের ৮৮ থেকে ৯২ নম্বর আয়াতে তা তুলে ধরেছেন এভাবে: 

'তারা বলে: দয়াময় আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছ।  হয় তো এর কারণেই এখনই নভোমন্ডল ফেটে পড়বে, পৃথিবী খণ্ড-বিখন্ড হবে এবং পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। এ কারণে যে, তারা দয়াময় আল্লাহর জন্যে সন্তান আহবান করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্য শোভনীয় নয়।'    

সুরা ইখলাসেও মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে: 'বলুন, তিনি আল্লাহ, এক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। তার সমতুল্য কেউ নেই।'

মোট কথা সুরা মারিয়ামে সামগ্রিকভাবে এই বার্তা তুলে ধরা হয়েছে যে: মহান আল্লাহর রহমত ও দয়া অশেষ। মহান আল্লাহ হযরত জাকারিয়ার মত একজন অক্ষম ও বৃদ্ধ এবং সৎ ব্যক্তির দোয়া কবুল করে তাঁকে এক যোগ্য ও নেক সন্তান দান করেছেন। আবার এই মহান ও অশেষ দয়াময় আল্লাহই পাপ ও নোংরা কাজে জড়িত একদল মানুষকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাই, মহান আল্লাহ যে দয়াময় হওয়ার পাশাপাশি যে কঠোর শাস্তিদাতাও- তা কারো ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।  অন্য কথায় আমাদের উচিত মহান আল্লাহর দয়ার ব্যাপারে নিরাশ না হওয়া এবং এর পাশাপাশি তাঁর ক্রোধ ও  শাস্তিকেও ভয় করা।

বলা হয় সন্তানহীনতার কারণে হজরত জাকারিয়া (আ) মনে মনে দুঃখ অনুভব করতেন। অথচ তিনি সন্তান লাভের ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে কখনও প্রার্থনা করেননি। জাকারিয়া নবী (আ) আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত ঈসার (আ) মাতা মারিয়ামের (সা. আ) অভিভাবকত্ব নেয়ার পর অনেকেই পরিহাস করে বলতো যে, নিজের সন্তান না থাকায় মারিয়ামের ওপর অভিভাবকত্ব করে সন্তানহীনতার দুঃখ মোচন করছেন জাকারিয়া! এ ছাড়াও তাঁর গোত্র ভবিষ্যতে তথা তাঁর মৃত্যুর পর পথ-প্রদর্শক বা নবীর অভাবে খুব বেশি পথভ্রষ্ট হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছিলেন বৃদ্ধ বয়সে। এ অবস্থায়  কোনো এক অলৌকিক ঘটনা দেখার তিনি ভাবলেন যে আল্লাহর কাছে সন্তান চাইলে আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দোয়া কবুল করবেন। ফলে মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর বৃদ্ধ বয়সে দান করেন ইয়াহিয়া (অ) নামক নেক সন্তান ও মহান নবী। উল্লেখ্য এর আগ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীও ছিলেন বন্ধ্যা ও বৃদ্ধা।#

পার্সটুডে/মু.আ. হুসাইন/আবু সাঈদ/২৯