ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৭ ২১:০৬ Asia/Dhaka

সুরা ত্বাহার গত পর্বের আলোচনায় আমরা হযরত মুসা (আ)’র জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরছিলাম। তিনি কিভাবে পবিত্র তুবা উপত্যকায় পৌঁছেন তা আমরা শুনেছি।

পবিত্র উপত্যকায় নবুওতের দায়িত্ব পাওয়ার পর মুসা নবী পান দু'টি অলৌকিক ক্ষমতা। এ প্রসঙ্গে সুরা ত্বাহার ১৭ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'হে মুসা, তোমার ডানহাতে ওটা কি? তিনি বললেন: এটা আমার লাঠি, আমি এর ওপর ভর দেই এবং এ দিয়ে আমার ছাগপালের জন্যে গাছের পাতা ঝেড়ে ফেলি এবং এতে আমার অন্যান্য কাজও চলে। আল্লাহ বললেন: হে মুসা, তুমি ওটা নিক্ষেপ কর। তিনি তখনই তা নিক্ষেপ করলেন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তা সাপ হয়ে ছুটোছুটি করছিল। আল্লাহ বললেন: তুমি তাকে ধর এবং ভয় পেয়ো না, আমি এখনি একে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেব। তোমার হাত বগলে রাখ, তা বের হয়ে আসবে নির্মল উজ্জ্বল হয়ে অন্য এক নিদর্শন রূপে; কোন ত্রুটি ছাড়াই।'

লাঠি থেকে সাপ হওয়া ও তা আবার লাঠিতে পরিণত হওয়া এবং হাত বগলে রাখার পর অসাধারণ মাত্রায় আলোক-উজ্জ্বল হয়ে ওঠা-

দু'টি বড় ধরনের মু'জেজা। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া শক্তি ছাড়া কেউ এমন মহা-বিস্ময়কর ঘটনা ঘটাতে সক্ষম নয়।

এরপর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিপজ্জনক ব্যক্তির কাছে খোদায়ী নির্দেশ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পান হযরত মুসা (আ)। সুরা ত্বাহার ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,‘হে মুসা! ফেরাউনের কাছে যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে।’

ফেরাউনের কাছেই প্রথমে মুসা নবীকে পাঠানোর ঘটনা থেকে বোঝা যায় সমাজ সংস্কারের কাজ শুরু করতে হয় সমাজের অধঃপতিত নেতা ও কাফিরদের সংশোধনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে। খোদাদ্রোহী ও তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল নবী-রাসূলদের প্রধান লক্ষ্য।  তবে মহাপুরুষদের বিজয়ের প্রধান চাবি হল দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা, প্রতিরোধ ও অসাধারণ ধৈর্য আর উদারতা। এ জন্যই হযরত মুসা (আ) তাঁর মিশন শুরুর আগে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে বলেছেন, ‘মুসা বললেন: হে আমার পালনকর্তা আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আর আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে এবং আমার পরিবারবর্গের মধ্য থেকে আমার একজন সাহায্যকারী করে দিন, আমার ভাই হারুনকে।’ (ত্বাহা,২৫-৩০) মহান আল্লাহ তাঁর এ দোয়া কবুল করেন এবং তা তাঁকে জানিয়ে দেন। (ত্বাহা-৩৬)

এরপর সুরা ত্বাহার ৩৭ ও ৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

‘আমি তোমার প্রতি আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম যখন আমি তোমার মাতাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যা অতঃপর বর্ণিত হচ্ছে।’

ফেরাউন বনি ইসরাইলের ক্ষমতাধর হওয়া ও তাদের সম্ভাব্য বিদ্রোহের ব্যাপারে আতঙ্কিত ছিল। সে গণকের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে এমন এক সন্তান বনি ইসরাইলের মধ্যে জন্ম নেবে যে তার রাজত্বকে বিলুপ্ত করবে। ফলে ফেরাউনের নির্দেশে বনি ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের হত্যা করা হত। আর তাদের কন্যাদেরকে করা হত দাসী। কোথাও কোনো পুত্র সন্তান জন্ম নিলে তার খবর ফেরাউনের গুপ্তচরদের কাছে চলে যেত। ফলে হত্যা করা হত ওই শিশু পুত্রকে।

হযরত মুসা যখন জন্ম নিলেন তখন তার মাও নবজাতক শিশুর জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এ অবস্থায় মুসা নবীর (আ) মা মহান আল্লাহর নির্দেশে সন্তানকে একটি বাক্সে ভরে নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দেন। প্রবল স্রোত এই বাক্সকে কোথায় নিয়ে যায় মুসা নবীর বোনকে তা দেখার দায়িত্ব দেন মমতামীয় মা।

এদিকে  নীল দরিয়ার তীরে বসে স্রোতের দৃশ্য উপভোগ করছিল ফেরাউন ও তার স্ত্রী। ফেরাউনের চোখ পড়ে ওই বাক্সের দিকে। সে নির্দেশ দেয় ওই বাক্সটি নিয়ে আসার।  বাক্সটি খোলার পর দেখা গেল সেখানে রয়েছে এক সুন্দর ফুটফুটে নবজাতক। ফেরাউন বুঝতে পারল যে পুত্র সন্তানকে বাঁচানোর জন্য এটা বনি ইসরাইলের কোনো পরিবারের কাজ।

ফেরাউন নির্দেশ দেয় এ শিশু মুসাকে হত্যা করার। কিন্তু বাধ সাধে তার স্ত্রী। কারণ, তার হৃদয়ের মধ্যে গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছিল ওই অপরূপ নবজাতক।  ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আসিয়া (সালামুল্লাহি আলাইহা) ছিলেন বন্ধ্যা। তিনি এই শিশুকে নিজের ও ফেরাউনের জন্য চোখের আলো বলে অভিহিত করেন। বিবি আসিয়া এই শিশুকে হত্যা করতে নিষেধ করেন। বরং শিশুটিকে নিজেদের পুত্র সন্তান হিসেবে ও তাদের ভবিষ্যতের আশার আলো হিসেবে গ্রহণ করার জোর অনুরোধ জানান। ফলে শিশু মুসা নবীর জীবন রক্ষা পেল এবং ফেরাউন-আসিয়া দম্পতির ঘরে মুসা পালিত পুত্র ও  তাদেরই ভবিষ্যতের আশার আলো হিসেবে আশ্রয় পেল। মহান আল্লাহ চাইলে কি না হয়! তাই যেখানে মুসা নবীর ছিল প্রাণের ভয় সেখানেই তিনি পেলেন আশ্রয়।

নবজাতক মুসার খিদে পেল। ফলে শুরু হল কান্না। বিবি আসিয়ার ঘুমন্ত মাতৃস্নেহ যেন প্রবল জোয়ারের মত দুলে উঠল। বহু ধাত্রী আনা হল। কিন্তু সমস্যা হল শিশু মুসা তাদের কারো দুধই পান করছে না।

ওদিকে  মুসার বোন মায়ের নির্দেশে ভাই মুসাকে ঘিরে জমে ওঠা ঘটনা-প্রবাহের খোঁজ-খবর রাখছিলেন ছদ্মবেশে। ফেরাউনের রাজপ্রাসাদের লোকদের তিনি জানান যে, আমি এমন এক নারীর কথা জানি যে এই শিশুর পরিচর্যা করতে সক্ষম। নিয়ে আনা হল সেই নারীকে। কিন্তু মা ও মেয়ে ছাড়া আর কেউ জানে না যে এই নার্সই হলেন স্বয়ং মুসার মা। নবজাতক মুসা অনুভব করল মায়ের গভীর ভালবাসাপূর্ণ স্পর্শ ও গন্ধ এবং পান করতে লাগল মায়ের দুধ। ফলে এই নারীকেই তথা মুসার মাকেই বিবি আসিয়া নিয়োগ দিলেন শিশু মুসার স্থায়ী নার্স হিসেবে। এভাবে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় মা ফিরে পেল তার নবজাতক শিশু মুসাকে।  এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে সুরা ত্বাহার ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

হে মুসা, যখন তোমার বোন এসে বলল: আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব কে তাকে লালন পালন করবে? এরপর আমি তোমাকে তোমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চক্ষু শীতল হয় এবং দুঃখ না পায় তথা কোনো ভয় ও দুশ্চিন্তা ছাড়াই তোমাকে লালন-পালন করতে পারে।

এরপরের ঘটনাগুলো আমরা তুলে ধরব এই আলোচনার আগামী পর্বে।#

 

পার্সটুডে/মু.আ. হুসাইন/আবু সাঈদ/৪