দেখব ঘুরে ইরান এবার: মিশকিন শাহর
আমরা ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আর্দেবিলের কেন্দ্রিয় শহর আর্দেবিলের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়িয়েছিলাম। বেড়াতে বেড়াতে আমরা দেখেছিলাম এখানকার এখানকার প্রাচীন বাজার কমপ্লেক্স, জুমা মসজিদ এবং কবরস্থানসহ আরো অনেক স্থাপনা। আজকের আসরে আমরা যাবো এই প্রদেশের একটি উপশহর “মিশকিন শাহরে”। সেখানকার দর্শনীয় বিভিন্ন স্থান ও কীর্তির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।
মিশকিন শাহ্র ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ৮৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর্দেবিল শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে সাবালন পর্বতের পাদদেশ জুড়ে শহরটি গড়ে উঠেছে। বিস্তীর্ণ একটি প্রান্তরের মতো শহরটি আগ্নেয়গিরি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা সাবালন পর্বতের ক্রমশ ঢালু পাদদেশে গিয়ে থেমে গেছে। চমৎকার উপভোগ্য আবহাওয়াময় পল্লীগ্রামের সৌন্দর্য সত্যিই দেখার মতো। এখানে নেই কোনো বালিয়াড়ি, আছে বসন্তের শোভাময় লালা ফুল বা টিউলিপ। এই সৌন্দর্যের কারণেই ইরানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় এলাকাগুলোর মাঝে মিশকিন শাহর উপশহরটি অন্যতম একটি দর্শনীয় এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশেষ করে বসন্তের আবির্ভাবে এখানকার চারদিক বিচিত্র ফুলে ফুলে ভরে যায়, ফলে মিশকিন শাহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি বেড়ে যায়।

প্রাকৃতিক এই ফুলেল সৌন্দর্য আর সবুজের সমারোহের মাঝে যদি প্রাকৃতিক ঝর্ণা তার স্বচ্ছ জলের অনবরত পতন ঘটাতে থাকে তাহলে তার সৌন্দর্য যে কী রকম বৃদ্ধি পায় সেটা বলাই বাহুল্য। আর মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসা জলের ফোয়ারা তো শতাধিক রয়েছে এখানে। এইসব ফোয়ারার জলের ধারা চারদিকে গড়িয়ে গিয়ে পরিবেশকে যেমন দূষণ থেকে মুক্তি দিচ্ছে তেমনি আবহাওয়াকে করে তুলছে মোলায়েম ও উপভোগ্য। এরিমাঝে মিশকিন শাহরের পশ্চিমে রয়েছে বন জঙ্গল আর বিচিত্র উদ্ভিদে ঢাকা অনেক চারণভূমি। এইসব বন বনানী আর চারণভূমি থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এখানে গড়ে উঠেছে বিচিত্র পশুপাখির নিরাপদ বসবাস। এই তো গেল মিশকিন শাহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর লীলা বৈচিত্রের কথা। এগুলোর বাইরেও এই শহরের রয়েছে ঐতিহাসিক মর্যাদা। আর্দেবিল প্রদেশের ঐতিহাসিক অঞ্চলগুলোর অন্যতম হচ্ছে এই মিশকিন শাহর।
এই উপশহরটির মূল কেন্দ্র হলো মিশকিনশাহর শহর। এই শহরে রয়েছে প্রকৃতির অনেক উপহার। যেমন এখানে আছে অসংখ্য টিলা, রয়েছে নিরাপত্তাব্যুহ অর্থাৎ বহু কেল্লা। আরো রয়েছে ইসলাম পূর্ববর্তী এবং ইসলাম পরবর্তী বিভিন্ন যুগের ঐতিহ্যের বহু নমুনা ও সভ্যতার অনেক নিদর্শন। এই অঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে আবিষ্কৃত সেইসব জিনিস খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর আগেকার বলে গবেষকদের ধারণা। অনেক অনেক ভূগোলবিদ যেসব বই পুস্তক লিখে গেছেন সেসব বইতে এবং কোনো কোনো ভূবন পর্যটকের লেখায় এই মিশকিন শাহরের নামটি উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হামদুল্ল... মুস্তাওফির নামটি উল্লেখ করা যায়। তিনি একটি বই লিখেছেন ‘নুযহাতুল কুলুব’ নামে। ঐ বইটিতেও মিশকিন শাহরের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন তিনি। তবে নামটিতে খানিকটা ব্যতিক্রম রয়েছে। তিনি শহরটি নাম উল্লেখ করেছেন ‘পিশকিন’ বলে।

মিশকিন শাহর উপশহরে ইসলামপূর্ব এবং ইসলাম পরবর্তী কালের বিভিন্ন যুগের অসংখ্য কীর্তিই প্রমাণ করছে এই এলাকাটি কতোটা প্রাচীন। শাহ ইসমায়িল সাফাভির পিতা ‘শায়খ হায়দার’ এর কবরস্থানের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনাটির কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। ‘শায়খ হায়দার’ এর কবরস্থানটি বাগানের ভেতর একটা টাওয়ারের মতো। বিশেষজ্ঞগণ এই টাওয়ারটিকে খ্রিষ্টিয় তেরো শতকের বলে অভিমত দিয়েছেন। শায়খ হায়দার সমাধি টাওয়ারটির উচ্চতা ১৮ মিটার। বাইরে থেকে দেখতে কলাম বা স্তম্ভাকৃতির। কিন্তু ভেতরে বারো কোণাকৃতির চমৎকার ডিজাইন করে সাজানো। টাওয়ারের কোনো কোনো অংশ ফিরোযা রঙের টাউলস দিয়ে চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। এই স্থাপনাটি খ্রিষ্টিয় ১৯৩২ সালে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের নিদর্শনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান নিদর্শনগুলোর মধ্যে মিশকিন শাহরের ‘প্রাচীন কেল্লা’ বা দূর্গটিও রয়েছে। এই কেল্লা বা দূর্গ থেকে যেসব মাটির তৈজস আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলো থেকে বিশষজ্ঞগণ বলছেন কেল্লাটি ইসলাম-পূর্ব কোনো যুগে নির্মিত হয়েছিল। এর দেয়ালগুলো তৈরি করা হয়েছে পাথর, চক পাউডার এবং ইট দিয়ে। এই দূর্গের ১৫০ মিটার দূরে পাহলভি ভাষায় একটি প্রস্তর লিখন পাওয়া গেছে। পাহলভি ভাষাটি ছিল প্রাচীন ইরানের জনগণের ভাষা। এই পাথর লিখনটি পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞগণ বলছেন যে সাসানীয় (৩০৯-৩৭৯) বাদশা শাপুর দ্বিতীয়ের সময়কার নিদর্শন এটি। এই প্রস্তরলিখনটিই অজারবাইজান এলাকায় পাওয়া সাসানী শাসনামলের সর্বপ্রথম লিখিত নিদর্শন।
মিশকিন শহরটি ‘এল সেভান’ উপজাতিদের এলাকায় যাবার পথে অবস্থানের কারণে এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে হস্তশিল্প সামগ্রী উৎপাদিত হয়। উপজাতীয়রাই এগুলো তৈরি করে। এই হস্তশিল্প সামগ্রীর কারণে সমগ্র অজারবাইজান প্রদেশের মাঝে মিশকিন শাহরের উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এখানে যেসব হস্তশিল্প তৈরি হয় সেগুলোর মাঝে গেলিম বোণা শিল্পটিই বেশি। ইরানের উপজাতীয়রা এবং পল্লীগ্রামের অধিবাসীরা এই গেলিম বোণার ক্ষেত্রে খুবই পারদর্শী। গেলিম অনেকটা কার্পেটের মতো করেই বোণা হয়। মিশকিন শাহরের উপজাতিরা তাদের পালিত পশুদের গায়ের লোম দিয়ে এইসব গেলিম বুণে থাকে। উপজাতীয় নারীরা বা মেয়েরাই সাধারণত এগুলো বোণে। এইসব অজানা অখ্যাত নারীরা নিজেদের পাঁচ আঙুলের হাতিয়ার দিয়ে যেসব শৈল্পিক নকশাময় গেলিম তৈরি করেন সেগুলো যে-কোনো দর্শককেই স্তম্ভিত করবে।
মিশকিন শাহরে গেলিম ছাড়াও ‘ভারনি” নামের বিশেষ এক ধরনের গেলিম পাওয়া যায়। সাধারণ গেলিমের চেয়ে এগুলোর বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য একটু আলাদা। খুবই সূক্ষ্ম কারুকাজ করা হয় ভারনিতে। এর ডিজাইনগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যচিত্র কিংবা উপজাতীয়দের জীবন যাপনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ থেকে নেওয়া হয়। সূক্ষ্ম কারুকার্যময় এই ভারনি গেলিমগুলো তাই ইরানের বাইরে বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে রপ্তানী করা হয়। কার্পেট বা গেলিমের বাইরে মৃৎ শিল্পের চর্চা হয় এই এলাকায়।
এ এলাকায় খনিজ গরম জলের ঝর্ণা বা ফোয়ারাও রয়েছে। এখানে তাই প্রায় সারা বছর জুড়েই পর্যটকরা ব্যাপকভাবে ভিড় জমান। মিশকিন শাহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে এরকম গরম জলের ফোয়ারা রয়েছে। এর নাম হলো ‘কেইনারজেহ’। আরো কয়েকটি গরম জলের ফোয়ারা হলো শাবিল, মুয়িল, মালেক সুয়ি ইত্যাদি। এগুলো না দেখলে বর্ণনা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।*
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি-৫৪/ অ-৫৪/ই-৫৪