মার্চ ০৬, ২০১৭ ২৩:৫৫ Asia/Dhaka

ইয়েমেনে গত দু বছর ধরে সৌদি আরব ও তার আরব মিত্র কয়েকটি দেশ যে সামরিক হামলা চালাচ্ছে সে সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার সৈয়দ আবুল মকসুদ রেডিও তেহরানের সাথে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। আর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ, ইয়েমেনে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় পুনর্বহালের কথা বলে জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই প্রায় দু বছর ধরে সৌদি আরব ও তার আরব মিত্র কয়েকটি দেশ সামরিক হামলা চালাচ্ছে। এ হামলা কতটা যৌক্তিক?

আবুল মকসুদ: দেখুন, যেসব ইস্যুতে প্রায় দু বছর ধরে সৌদি আরব ও তার আরব মিত্র কয়েকটি দেশ ইয়েমেনে বর্বর হামলা চালাচ্ছে, তার মধ্যে কোনোরকম যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা নেই। কোনো দেশের গণতন্ত্র বলতে সেই দেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি প্রতিফলিত হবে। আমরা এমনটিই জানি। কিন্তু পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছে- তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী তারা কোনো একটি দেশের শাসককে ক্ষমতায় বসাবেন। আর তাদের মতে সেই সরকার হবে গণতান্ত্রিক সরকার।

ইয়েমেন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমি যে কথাটি বলতে চাই সেটি হচ্ছে- সিরিয়া, ইরাকসহ অন্যান্য জায়গায় যেসব ঘটনা ঘটছে তা যতটা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সেই অনুপাতে ইয়েমেনের নৃশংস ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান পাচ্ছে খুবই কম। অথচ সেখানে চলছে নিষ্ঠুর বর্বরতা। ইয়েমেনে ঘটে যাওয়া বর্বরতা শুধু মানবাধিকার লংঘনের মধ্যে পড়ে তাই নয়; সেখানে গণহত্যা চলছে বলে আমি মনে করি। শুধু তাই নয়, যত রকমের মানবতাবিরোধী কাজ তার সবই চলছে ইয়েমেনিদের ওপর। অথচ পৃথিবী সে ব্যাপারে নীরব রয়েছে।

আরেকটি বিষয় বলব, সেটি হচ্ছে- ইয়েমেনে সৌদি আরব ও তার আরব মিত্র কয়েকটি দেশ যে হামলা চালাচ্ছে প্রায় দু বছর ধরে তাতে জাতিসংঘের কোনো অনুমোদন নেই-তাহলে তারা কীভাবে হামলা চালাচ্ছে? তাহলে জাতিসংঘ নামক প্রতিষ্ঠানটি তো অর্থহীন একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি রাখার তাহলে কোনো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না।

সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি আরব মিত্র দেশ ইয়েমেনে যে ভূমিকা পালন করছে তা অমুসলিম দেশের মানুষদেরও হতবাক করছে। সৌদি আরবের উচিত ছিল  মুসলিম বিশ্বে একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা। কিন্তু সেই নিরপেক্ষ অবস্থান তো দূরের কথা তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ও তাদের সহযোগী হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দৃষ্টিকটু ভূমিকা রাখছে। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। ফলে ইয়েমেনে সৌদি আরবসহ  মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশের ভূমিকা পৃথিবীর বিবেকসম্পন্ন মানুষকে ব্যথিত করছে। ইয়েমেনে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, সেখানকার জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে শাসক বানিয়ে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীরা ও পুঁজিবাদীরা সেইসব শাসকদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করবে এবং সেখানকার জনগণের ইচ্ছাকে পদদলিত করবে এই একুশ শতকে এ বিষয়টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এতে যৌক্তিকতার লেশমাত্র নেই।

রেডিও তেহরান: দীর্ঘ সময় ধরে দারিদ্রপীড়িত ইয়েমেনে সৌদি আরব আগ্রাসন চালালেও মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই। কেন কেউ প্রতিবাদ করছে না? এই নীরবতা ইয়েমেনে হামলা জোরদার করতে সৌদি আরবকে কী উৎসাহ যোগাচ্ছে না?

আবুল মকসুদ: আমি আবারও খুব সুস্পষ্ট করে বলছি- ইয়েমেনের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা খুবই খারাপ। সৌদি আরব একটি ধনী দেশ। অন্যদিকে ইয়েমেন একটি দারিদ্রপীড়িত দেশ। তাদের অভাব-অনটনসহ যে আর্থিক সমস্যা রয়েছে সে ব্যাপারে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর উচিত ছিল তাদেরকে সহযোগিতা করা। অথচ সেদিকে তারা দৃষ্টি না দিয়ে উল্টো সেখানে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড চালাতে তারা সহযোগিতা করছে। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে এসব কাজ করছে।  বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন মানুষকে যে বিষয়টি বিস্মিত করছে, বেদনাহত করছে সেটি হচ্ছে- একটি দরিদ্রপীড়িত মুসলিম দেশকে বিপর্যস্ত করতে সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ উঠেপড়ে লেগেছে।

রেডিও তেহরান: অনেকে বলছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল যেমন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ওপর কয়েকবার হামলা চালিয়েছে ঠিক ইয়েমেনে তেমনই হামলা চালাচ্ছে সৌদি আরব। ইসরাইলের বিরুদ্ধে মুসলমানরা প্রতিবাদ করে কিন্তু সৌদি আরবের বর্বরতার প্রতিবাদ করছে না। এর কারণ কী বলে মনে করেন আপনি?

আবুল মকসুদ: দারিদ্রপীড়িত ইয়েমেনে সৌদি আরব আগ্রাসন চালালেও মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই। কেউ প্রতিবাদ করছে না কেন- তার মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলতে চান না বা সমালোচনা করতে চান না। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার বা বিশ্ব বিবেকের মনে রাখা দরকার যে, সৌদি আরবও একটি রাষ্ট্র। তারা যদি কোনো মানবতাবিরোধী কাজ করে বা এ ধরনের কাজ করতে সহযোগিতা করে তাহলে সবারই উচিত এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আর মনস্তাত্ত্বিক কারণ হচ্ছে- সেখানে পবিত্র কাবা ঘর রয়েছে। সেখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু হয়েছে ইত্যাদি। আর এসব কারণে মানসিকভাবে অনেকে সৌদি আরবকে খুব সমীহ করে চলে। কিন্তু বর্তমানে সৌদি আরবের যে রাজনৈতিক ভূমিকা তা নিন্দনীয়। তারা আমেরিকার সহযোগী। আমেরিকার অন্যায়কে তারা প্রতিবাদ না করে তাদের অন্যায়ের তারা সহযোগী। আর এ বিষয়টি সৌদি আরব ও মুসলিম বিশ্বের জন্য খুবই বেদনাদায়ক।

রেডিও তেহরান: ইয়েমেনে সৌদি আরব ও তার মিত্র কয়েকটি দেশের আগ্রাসনকে কেউ কেউ শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব বলে প্রচার করছে। আসলে বিষয়টি কী তাই? 

আবুল মকসুদ: দেখুন, এ বিষয়টি নতুন কোনো বিষয় নয়। পশ্চিমারা যখনই তাদের কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করতে যায় তখনই তারা ধর্মের বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসে। শিয়া-সুন্নির বিষয়টি আমাদের উপমহাদেশেও আছে, মধ্যপ্রাচ্যেও একই চিত্র। প্রথমে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে। আর ধর্মের ব্যবহার করে মুসলমানদের মধ্যেই স্বার্থান্বেষী মহল একটা বিরোধ বাধিয়ে দেয়। ইয়েমেনের ক্ষেত্রেও তারা সেই ধরনের চক্রান্ত করবে সেটাই স্বাভাবিক। কোনো বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারলে সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কাজেই স্বার্থান্বেষী মহলের জন্য ধর্মীয় বিভেদটা খুব বেশি প্রয়োজন। আর ধর্ম নিয়ে বিভেদটা মানুষের খুব স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করে। তখন মানুষ খুবই হিংস্র হয়ে ওঠে। আর তখনই মানুষ ভ্রাতৃঘাতী কাজ  করতে পারে।

রেডিও তেহরান: ইয়েমেন সংকট নিরসনে মুসলিম বিশ্ব কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

আবুল মকসুদ: দেখুন, প্রাথমিক ভূমিকাটা ছিল মুসলিম বিশ্বের। ইয়েমেন সংকট নিরসনে মুসলিম বিশ্বের বিবেক জাগ্রত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয় সেই জায়গাটিতে মুসলিম বিশ্বের কোনো সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় নি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৬