মার্চ ২৯, ২০১৭ ১৮:৫৯ Asia/Dhaka

আজ আমরা অন্য কোনো প্রদেশে যাবো বলে আপনাদের কথা দিয়েছিলাম। আপনারা ইরানের শোমলের কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। শোমল ফার্সি শব্দ। মানে হলো উত্তর। শোমলে ইরান মানে হলো ইরানের উত্তরাঞ্চল। এই শোমলে রয়েছে তিনটি প্রদেশ। গিলান, মযান্দারন এবং গোলেস্তন। আজ যাওয়া যাক গিলান প্রদেশের দিকে।

ইরান প্রাকৃতিক বৈচিত্রে পূর্ণ চমৎকার একটি দেশ। এই দেশে রয়েছে বিচিত্র আবহাওয়া। সভ্যতার বিভিন্ন কালপর্বের ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন রয়েছে ইরানে। যিনিই ইরানের এই বিশাল ভূখণ্ডে সফর করতে যাবেন তিনি প্রতিটি অঞ্চলেই ইসলামী যুগের কিংবা ইসলাম পূর্ব যুগের কোনো না কোনো নিদর্শন দেখতে পাবেন। এগুলো দেখে যে কোনো দর্শকই যে আপ্লুত হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা শোমলের কথা বলছিলাম। শোমল কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী সবুজের সমারোহে পূর্ণ চমৎকার একটি এলাকা। এই কাস্পিয়ানের সমতল উপকূলের আয়তন কমপক্ষে ছয় শ কিলোমিটারের মতো। এখানে একদিকে যেমন রয়েছে পার্বত্য এলাকা তেমনি রয়েছে শহরাঞ্চলও। শহরের বাইরে গ্রামীণ চমৎকার পরিবেশও এখানকার উপভোগ্য এলাকা। তাছাড়া শোমলের লোকজন যথেষ্ট মেহেরবান বা দয়ালু। এ অঞ্চলের লোকজনের অতিথি পরায়নতার কথা সবার মুখে মুখে শোনা যায়। যার ফলে ছুটির অবসর কাটানো কিংবা বিশ্রাম নেওয়া বা অবকাশ যাপনের জন্যে এ এলাকার কোনো জুড়ি নেই।

গিলান

এই শোমলেরই হৃদয় কেড়ে নেওয়া সৌন্দর্যময় একটি শ্যামল প্রদেশ হচ্ছে গিলান। সাগর উপকূলবর্তী এই গিলান যেন সবুজ ঘাগরা পরে সু-উচ্চ আলবোর্য পর্বতমালার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তার ঘাগরার বিস্তীর্ণ প্রান্ত যেন ছায়া দিয়ে রেখেছে কাস্পিয়ানের পুরো উপকূলটাকে। এই গিলানের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় নজর দিলে দেখা যাবে ইরানের ইতিহাসের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে মির্যা কুচাক খান জাঙালির মতো বিপ্লবী সংগ্রামীদের অস্তিত্ব সমগ্র ইরানের ইতিহাসের পাতাগুলোকে স্বর্ণালী ঔজ্জ্বল্যে ঝকমকে করে তুলেছে।

ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় গিলান প্রদেশটির আয়তন এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল জুড়ে বিস্তৃত এই প্রদেশটি। এই প্রদেশটির উত্তর দিকে কাস্পিয়ান সাগর এবং আজারবাইজান, পশ্চিমে আর্দেবিল প্রদেশ, দক্ষিণে যানজন এবং ক্বাজভিন প্রদেশ আর পূর্বে রয়েছে মযান্দারন প্রদেশ।

কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ সমতলভূমিটা ব্যাপক পলিময়। কেননা আলবোর্য পর্বতমালা এবং তলেশ পর্বতগুচ্ছ থেকে নিসৃত জলের ধারা থেকে যেসব নদীর জন্ম হয়েছে, ঐসব নদী সাগরের দিকে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে আসে পলিগুলো। সময়ের ব্যবধানে সেইসব পলি ধীরে ধীরে জমে এই সমতল ভূমিটাকে করে তুলেছে উর্বর। যার ফলে গিলানের আবাসিক এলাকা কিংবা শহরাঞ্চল সবখানেই বেশিরভাগ কৃষিকাজেরই প্রচলন বেশি। এই সমতলভূমির দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলটাই সবচেয়ে বড়ো। বন জঙ্গলময় পার্বত্য এলাকা থেকে এই অঞ্চল অর্থাৎ কাস্পিয়ান সাগরের দূরত্ব একটু বেশি। তবে কাস্পিয়ান সাগর থেকে গিলানের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলের দূরত্ব কম-পাঁচ কিলোমিটারের চেয়েও কম।

আলবোর্য পর্বতমালার উচ্চতা তিন হাজার মিটারের মতো। গিলানের দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে দেয়ালের মতো বিস্তৃত এই পর্বতমালাটি। গিলান প্রদেশের আবহাওয়া ভূমধ্যসাগরীয় নাতিশীতোষ্ণ বলেই খুবই উপভোগ্য। এই চমৎকার আবহাওয়ার উৎস হলো কাস্পিয়ান সাগরের অস্তিত্ব এবং আলবোর্য পর্বতমালার পার্বত্য আবহাওয়া। তবে আলবোর্যের উত্তর এবং পূর্ব উপত্যকায় বিরাজ করে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা এবং আর্দ্র আবহাওয়া। সমগ্র ইরানের মধ্যে সবচেয়ে আর্দ্রতাপূর্ণ এলাকা হিসেবে এই এলাকাটিই পরিগণিত। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি বলেই এখানকার আবহাওয়াটা নাতিশীতোষ্ণ। এই বৃষ্টিপাতের আধিক্যের বহু কারণ অবশ্য আবহাওয়াবিদগণ উল্লেখ করেছেন। আমরা সেসব নিয়ে কথা বলে ভ্রমণের আনন্দকে চিন্তার জগতে ঠেলে দিতে চাই না। যেহেতু আমরা বলেছি যে এলাকাটি বেশ পলিময় সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই এখানে বিচিত্র ফসল উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন ফসলাদির মধ্যে রয়েছে ধান, তামাক এবং চা। এ কয়টা ফসল ইরানের অপরাপর এলাকার চেয়ে খুব বেশি উৎপন্ন হয় এখানে। তবে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা হবার কারণে এখানে বাগান কেন্দ্রিক ফল-ফসলও ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যায়।

গিলানের ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির সাথে পরিচিত হবার জন্যে পুরাতাত্ত্বিক গবেষকদের সাহায্য নেবো আমরা। সেইসাথে তাঁদের গবেষণামূলক খননকাজ থেকে আবিষ্কৃত বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন। তাঁরা যেসব জিনিস বা প্রমাণপঞ্জি খুঁজে পেয়েছেন খনন করে, সেগুলো আমাদেরকে হাজার বছর পেছনে নিয়ে যায়। পেছনে ফেলে আসা গভীর অন্ধকারময় দীর্ঘ পথে পুরাতাত্ত্বিকদের আবিষ্কৃত জিনিসগুলো যেন মশালের মতো পথ নির্দেশ করে। তবে মশালের আলোয় পেছনে যাওয়া যাক না কেন এ পথের কোনো শেষ বলে কিছু নেই। এই সত্যটিকে মেনে নিয়েই বলতে হয় গিলানের ইতিহাসকে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ করা সম্ভব হয় না। কাস্পিয়ান উপকূলীয় অঞ্চলে পুরাতাত্ত্বিকগণ গবেষণামূলক খননকাজ চালিয়ে যেসব মূল্যবান নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন সেগুলো প্রমাণ করে কয়েক হাজার বছর আগে ইরানের এই উত্তরাঞ্চলে মানব বসতি ছিল। আর্নেস্ট হার্টসফিল্ড, আর্থার কিথ, হেনরি ফিল্ড, গ্রিসম্যান এবং দিয়াকুনুফের মতো ইতিহাসবিদ কিংবা গবেষকগণ এইসব তথ্যপঞ্জির ভিত্তিতে মনে করেন আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে গিলান এবং মযান্দারনে উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। এমনকি কেউ কেউ মনে করেন সমকালীন অন্যান্য সভ্যতায় গিলানের সেই সভ্যতার প্রভাবও ছিল।

তবে সর্বজনস্বীকৃত বিষয়টি হলো গিলান, গোরগান এবং মযান্দারনসহ কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় কয়েক হাজার বছরের সমৃদ্ধ সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। আমলাশ, দেইলাম, রুদবর, তলেশ, রহমতাবাদসহ গিলানের অন্যান্য এলাকার মাটি খুঁড়ে প্রাচীন যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে এই এলাকার সহস্র বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সভ্যতার সত্যতা মেলে। বিজ্ঞানীগণ এইসব নিদর্শন পর্যালোচনা করে বলেছেন নিদর্শনগুলো যে অন্তত চার হাজার বছরের আগেকার সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অস্ট্রেলিয়ার মধ্যপ্রাচ্যবিদ বিশিষ্ট লেখক উইলিয়ম গ্যালিকন একটি বই লিখেছেন ‘মাদ্দি হ ওয়া ফার্সি হ’ নামে। ঐ বইতে তিনি যা লিখেছেন তা এ অঞ্চলের প্রাচীনত্বের দাবিটাকে প্রামাণ্য করে তোলে। তাঁর বইতে তিনি এখানকার মার্লিক টিলায় আবিষ্কৃত জিনিসপত্রের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৯/ই-৫৬