এপ্রিল ২৫, ২০১৭ ১৭:৩৪ Asia/Dhaka

মদীনায় প্রথম ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মসজিদ ছিল প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা সরাসরি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। এই পবিত্র প্রতিষ্ঠানটি গত ১৪০০ বছরে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো মসজিদের বাহ্যিক চেহারাকে রাজপ্রাসাদের আকৃতি দেয়া হলেও ইবাদত-বন্দেগীর পবিত্র স্থান হিসেবে মসজিদের ভূমিকা কখনো ম্লান হয়ে যায়নি।

আজকের আসরে আমরা মসজিদ নিয়ে আরো কিছু কথা বলার পাশাপাশি মদীনায় কুবা মসজিদ ও মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

মসজিদ হচ্ছে কিবলামুখী একটি পবিত্র স্থান যা নির্ধারিত হয়েছে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মসজিদ দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকলেও কোথাও কোথাও দেয়ালবিহীন মসজিদও দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো মসজিদে রয়েছে রেশমি কার্পেট আবার কোনো কোনো মসজিদে বালুর তপ্ত ভূমির উপরে মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে হয়। কোনো কোনো মসজিদে রয়েছে সুউচ্চ ছাদ, আকাশচুম্বী মিনার এবং দেয়ালে রয়েছে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। আবার কোনো কোনো মসজিদে এসবের কোনো কিছুর বালাই নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, পবিত্রতা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জিনের দিক দিয়ে এই দুই ধরনের মসজিদের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য মসজিদের বাহ্যিক বেশভূষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তবে হ্যাঁ মসজিদে যতই দারিদ্রের ছাপ থাকুন না কেন এটিকে পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও পাকপবিত্র রাখতে হবে।

কুবা মসজিদ

মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পরপরই সর্বপ্রথম ইসলামি শাসনকাজ পরিচালনার স্থান হিসেবে মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত দেন। শুধু নামাজ আদায় নয় সেইসঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি এই পবিত্র স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন। যে স্থানে শাসক ও শাসিত দুজনই উপস্থিত থাকবেন এবং যেখানে আল্লাহর হুকুম-আহকাম শিক্ষা দেয়া হবে। সাহাবীদের সঙ্গে বিশ্বনবীর মিলনমেলা ছিল এই মসজিদ। রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের কাছে ধর্মের দাওয়াত দিতেন। সমাজে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কোনো কাজ তিনি আগে নিজে করে দেখাতেন এবং তারপর সবাইকে করতে বলতেন। দূর-দূরান্ত থেকে কেউ বিশ্বনবীর সঙ্গে দেখা করতে আসলে তার সঙ্গে তিনি মসজিদে সাক্ষাৎ করতেন। কোনোকিছু জনগণকে জানাতে চাইলে এই মসজিদে বসেই তিনি নিজে কিংবা কোনো একজন সাহাবীর মাধ্যমে তা সবাইকে জানাতেন।

মদীনায় ইসলামের প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল কুবা নামক স্থানে। নির্ভরযোগ্য হাদিসগ্রন্থে এই মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস এভাবে বর্ণিত হয়েছে- মহানবী (সা.) সোমবার দিন মদীনার কুবা এলাকায় প্রবেশ করেন। এলাকাটিতে ছিল প্রচুর খেজুরের বাগান। এই এলাকার মানুষ সর্বপ্রথম আল্লাহর রাসূলকে স্বাদরে গ্রহণ করেন। কুবায় প্রবেশ করার পর তিনি চারদিন সেখানেই অবস্থান করেন। এরইমধ্যে হযরত আলী (আ.) এবং ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহাসহ তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা সেখানে পৌঁছে যান। এরপর তাঁরা সবাই মিলে মদীনার দিকে যাত্রা করেন। মদীনা সে সময় ইয়াসরিব নামে বেশি পরিচিত ছিল। কুবায় অবস্থান করার দিনগুলোতে বিশ্বনবী (সা.) প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন যার নাম দেয়া হয় কুবা মসজিদ। তিনি এই মসজিদে নামাজ আদায় করার ব্যাপারে বলেন, “যে ব্যক্তি আমার নির্মিত মসজিদ অর্থাৎ কুবা মসজিদে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে তার আমলনামায় একটি ওমরাহ হজের সওয়াব লিখে দেয়া হবে। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) মূল মদীনা শহরে বসবাস শুরু করলেও সপ্তাহে একবার- কখনো শনিবার বা কোনো কোনো সপ্তাহে সোমবার নামাজ আদায় করার জন্য কুবা মসজিদে যেতেন।  

আগেই যেমনটি বলেছি, মহানবী (সা.) চারদিন কুবায় অবস্থানের পর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মূল মদীনা শহরের দিকে অগ্রসর হন। স্থানীয় জনগণ বিশ্বনবী ও তাঁর সাহাবীদের বিপুল সংবর্ধনা দেন। প্রতি গোত্রের প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজ নিজ গোত্রে বিশ্বনবীকে আতিথেয়তা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন। কেউ কেউ এসে রাসূলের উটের রশি ধরে টানাটানি শুরু করেন। বিশ্বনবী একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কাকে রেখে কাকে খুশি করবেন! এ অবস্থায় তিনি নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানান। বলেন, আপনারা উটের রশি ছেড়ে দিন। দেখি উটটি কোথায় গিয়ে বসে পড়ে। সে যার বাড়ির সামনে বসে পড়বে আমি সেই বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করব।

এই ঘটনায় দু’টি উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমত, রাসূলের উটটি যেখানে থেমেছিল এবং যেখানে এখন মসজিদে নববী রয়েছে সেটি নির্বাচন করে দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এমনক এটি নির্ধারণে বিশ্বনবীরও হাত ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে মদীনার কোনো গোত্র মন খারাপ করার সুযোগ পেল না। আল্লাহর রাসূলের উটটি বনি মালিক বিন নাজ্জার নামক স্থানে গিয়ে বসে পড়ল। বিশ্বনবী (সা.) ওই জায়গায়ই মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। মসজিদ নির্মাণের কাজে আল্লাহর রাসূল নিজে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন। তাঁর পরিশ্রম দেখে সাহাবীরা বহুবার তাঁকে বিশ্রাম নেয়ার অনুরোধ করলেও তিনি সে অনুরোধ রক্ষা না করে সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মসজিদ নির্মাণের কাজে অংশ নিয়েছেন।

মসজিদে নববী

মসজিদে নববীকে তখনকার যুগের একটি অনন্য স্থাপনা হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বনবী। সে সময় অন্য কোনো স্থাপত্যশিল্প, এমনকি অন্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোর নির্মাণশৈলির সঙ্গে এর কোনো মিল ছিল না; বরং ইসলামের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে এই মসজিদ ছিল সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে বিশ্বনবী তৎকালীন শাম বা সিরিয়াসহ আরো কিছু দেশ সফর করেছিলেন। এসব সফরে তিনি বহু গির্জা ও সিনাগগ ঘুরে দেখেছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে এসব উপাসনালয়ের নির্মাণশৈলি রাসূলুল্লাহ (সা.) র মাথায় ছিল। মসজিদে নববী তৈরির সময় ওই সব উপাসনালয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি নকশা তিনি দাঁড় করান। ভূমি থেকে এক মিটার উচ্চতা পর্যন্ত মসজিদের দেয়াল পাথর দিয়ে নির্মিত হয়। এরপর ছাদ পর্যন্ত দেয়া হয় রোদে পোড়ানো ইট। আর ছাদ তৈরি হয় খেজুর পাতা দিয়ে।

মসজিদে নববী তৈরি হওয়ার পর এর একাংশকে দরিদ্র মানুষের বসবাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব দরিদ্র মানুষের বেশিরভাগই ছিলেন মক্কা থেকে আসা মুহাজির। মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তাঁরা নিজেদের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বল ফেলে এক কাপড়ে রাসূলের সঙ্গে হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন। বিশ্বনবীর এসব সাহাবীকে আসহাব আস-সুফফা বলা হয়। মসজিদে নববীর সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)’র বসবাসের জন্য তৈরি হয়  একটি ঘর।  পরবর্তীতে সাহাবীদের মধ্যে সামর্থ্যবানরাও মসজিদের পাশে ঘর তৈরি করে মসজিদ অভিমুখে একটি করে দরজা রেখেছিলেন। নামাজের সময় হলে তারা ওই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। তৃতীয় হিজরিতে বিশ্বনবী (সা.) আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ছাড়া আর সবার ঘরের মসজিদ অভিমুখী দরজা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন।

আহলে সুফফাদের বসবাসের স্থান

রাসূলুল্লাহ (সা.)’র ইন্তেকালের পর মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদে নববীতে মুসল্লিদের স্থান সংকুলানের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে খলিফারা এই মসজিদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। মসজিদ সম্প্রসারণের এই কাজ কয়েক ধাপে চলে এবং আব্বাসীয় শাসনামলে এর আয়তন দাঁড়ায় ৯,০০০ বর্গমিটার। ওসমানীয় শাসনামলে মসজিদে নববী কয়েকবার পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১২৬৫ হিজরিতে সুলতান আব্দুল হামিদ এই মসজিদ সংস্কারের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেন যা বাস্তবায়ন করতে ১৩ বছর সময় লাগে।

মসজিদে নববীর শিলালিপিতে বর্তমানে রাসূলের আহলে বাইত, নিষ্পাপ ইমাম ও খলিফাসহ আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবীর যেসব নাম আজও চোখে পড়ে তা ওসমানীয় শাসকদের লেখা। সৌদ রাজবংশ ক্ষমতায় আসার পরও কয়েক দফায় মসজিদে নববীর সংস্কার ও সম্প্রসারণ ঘটানো হয়েছে।  মদীনা শহরের সম্মান বৃদ্ধি করেছে এই মসজিদ। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, হযরত ইব্রাহিম মক্কাকে নিরাপদ শহরে পরিণত করেছেন এবং এর অধিবাসীদের জন্য দোয়া করেছেন। আর আমি মদীনাকে করেছি নিরাপদ।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/২৫

ট্যাগ