সুরা আম্বিয়ার কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা (দুই)
মহান নবী-রাসুলদের জীবনের নানা দিক এ সুরায় আলোচিত হয়েছে। তাই এ সুরার নামকরণ হয়েছে সুরা আম্বিয়া। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল।
সর্বশেষ এই রাসূলের আগে যাঁরা এসেছেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কয়েকজন রাসূল হলেন যথাক্রমে: হযরত নুহ, হযরত ইব্রাহিম, হযরত মুসা ও হযরত ঈসা (আলাইহিমুসসালাম)। বিশ্বনবী (সা) ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ)’র পুত্র ইসমাইল (আ)’র বংশধর।
যাই হোক, সুরা আম্বিয়ার ৩০ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতে সৃষ্টি জগতের নানা ক্ষেত্রে খোদায়ী কিছু নিদর্শন এবং মহান আল্লাহর মাধ্যমে সৃষ্টি জগত পরিচালনা সম্পর্কে কথা রয়েছে। যেমন, ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরকে জড়িয়ে ছিল,এরপর আমি উভয়কে আলাদা করলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা ইমান আনবে না?’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বিশ্ব জগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো দলা পাকিয়েছিল উত্তপ্ত বাষ্প বা মেঘকূণ্ডের মত। আর এর ভেতরের এক বিস্ফোরণের ফলে ও গতিশীলতার কারণে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং সৌর জগত ও গ্রহ-নক্ষত্রগুলো আলাদা হয়। ধর্মীয় নানা বর্ণনায়ও বলা হয়েছে যে, প্রথমদিকে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হত না এবং ভূমিতে জন্মাত না গাছপালা। মনে হয় যেন এ দুইই ছিল আবদ্ধ। কিন্তু আল্লাহ এ দুইয়ের মুখ বা আবরণ খুলে দেন। ফলে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামল ও নানা গাছপালায় ভরে উঠল পৃথিবীর ভূমি।
সুরা আম্বিয়ার ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘আমি পৃথিবীতে স্থির পাহাড়-পর্বত গেড়ে দিয়েছি যাতে তাদেরকে নিয়ে পৃথিবী নড়াচড়া না করে এবং পাহাড় ও উপত্যকাগুলোর মাঝে প্রশস্ত পথ রেখেছি, যাতে তারা সুপথ পায়।’
এ আয়াত থেকে বোঝা যায় পাহাড়গুলো যেন পৃথিবীর সুরক্ষার ঢাল। পাহাড়গুলো না থাকলে মারাত্মক ভূমিকম্পে পৃথিবীর সব মানুষ মারা যেত। পৃথিবীর ভূভাগের নীচে যে গ্যাস আছে তার প্রভাবে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। কিন্তু পাহাড়গুলোর কারণে এই নড়াচড়ার মাত্রা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকে। এ ছাড়াও পাহাড়গুলো প্রবল ঘূর্ণি-হাওয়াকে প্রতিহত করে। সমতল-ভূমি বা মরুভূমিতে এ জন্যই প্রবল ধুলি-ঝড় হয়ে থাকে। আবার ভূভাগের সবটাই যদি এবড়ো-থেবড়ো উঁচু পাহাড়ে ভরা থাকত তাহলে মানুষ পথ-ঘাট চিনতে পারত না। তাই পাহাড়গুলোর পাশে মাঝে মধ্যে দেয়া হয়েছে সমতল প্রান্তর ও নীচু উপত্যকা যাতে মানুষ পথ চিনে নিজ লক্ষ্যপানে পৌঁছতে পারে। অন্য কথায় সব স্থানেই কেবল পাহাড়-পর্বত থাকলে পাহাড়গুলো উঁচু প্রাচীরের মত জনবসতিগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখত। তাই এটা বোঝা যায় যে মহান আল্লাহ সুপরিকল্পিতভাবেই গড়ে তুলেছেন সব কিছু।
মহান আল্লাহ সুরা আম্বিয়ার ৩২ নম্বর আয়াতে বলছেন: ‘আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ করেছি;অথচ তারা আকাশে-থাকা আমার নিদর্শনগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।’
এখানে বায়ুমণ্ডলের কথা বলা হচ্ছে যা পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। এই বায়বীয় স্তরের পুরুত্ব শত শত কিলোমিটার। দেখতে নরম মনে হলেও গ্যাস ও বাতাসের তৈরি এ স্তর আসলে এতটাই মজবুত যে পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকারক কোনো পদার্থ এই স্তর অতিক্রমের চেষ্টা করলে ধ্বংস হয়ে যাবে। মহাকাশে প্রায়ই যেসব ধূমকেতু বর্ষিত হচ্ছে তা এই বায়বীয় স্তরই ঢাল হিসেবে প্রতিহত করছে। তা না হলে ধূমকেতুর পাথরগুলোর আঘাতে বহু আগেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত।
এ ছাড়াও সূর্যের আলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর অনেক রশ্মি। পৃথিবীর বায়বীয় স্তর এইসব ক্ষতিকর রশ্মিকে দুর্বল করে দেয়। সূর্য ছাড়াও নানা উৎস হতে আসা প্রাণঘাতী রশ্মিগুলোকে প্রতিহত করে এই বায়ুমণ্ডল। অন্যদিকে পৃথিবীর তাপমাত্রাকেও নানা ধরণের জীবের জন্য সহনীয় মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখে এই বায়বীয় স্তর। পানি ও জলীয় বাস্পকে মহাসাগরগুলো থেকে শুকনো ভূভাগে স্থানান্তর করাও এই বায়ুমণ্ডলের আরেকটি অবদান। পানি ও জলীয় বাস্প এভাবে স্থানান্তরিত না হলে ভূভাগের সবই মরুভূমি হয়ে যেত এবং পৃথিবী হয়ে পড়ত বসবাসের অযোগ্য।
এ আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় আকাশ, বাতাস, পাহাড়, বায়ুমণ্ডল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিষয়গুলো মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতা আর মহাকৌশলের নিদর্শন। আর এসবই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ। তাই প্রকৃতিকে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও জ্ঞান অর্জনের এক বড় চাবি। মানুষ সব সময়ই চোখের সামনে এসব বিষয়কে দেখছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে তাদের নানা কাজ কর্ম থাকা সত্ত্বেও সেগুলো তাদের জন্য গভীর চিন্তাভাবনার উপজীব্য হয়ে ওঠে না এবং এইসব বিস্ময়কর প্রাকৃতিক বিষয়ের স্রস্টা সম্পর্কেও বেশিরভাগ মানুষ অসচেতন। অথচ এসবই হতে পারত মহান আল্লাহকে চেনা ও জানার এবং খোদা-প্রেম ও ঈমান জোরদারের অত্যন্ত ভালো মাধ্যম। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/৬