সুরা আম্বিয়ার কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা (তিন)
সুরা আম্বিয়ার ৪৮ নম্বর আয়াত থেকে নবী-রাসুলদের জীবনের শিক্ষণীয় কোনো কোনো দিক বা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, হযরত মুসা, ইব্রাহিম, নুহ, লুত ও আইয়ুব (আলাইহিমুসসালাম)-এর মত মহান নবীদের জীবনের শিক্ষণীয় কিছু দিক স্থান পেয়েছে এ সুরায়।
মহান আল্লাহ বলছেন, ভয়াবহ নানা বিপদ ও দুর্যোগে এই নবীরা ধৈর্য ধরেছিলেন এবং তারা সেইসব কঠিন অবস্থায়ও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে খোদায়ী পরীক্ষাগুলোয় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বলেই তাদেরকে আমি বড় ধরনের নেয়ামত দান করেছি। সুরা আম্বিয়ার ৮৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
‘আমি তাঁদেরকে আমার রহমতের মধ্যে শামিল করে নিয়েছিলাম। তাঁরা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ।’
এখানে লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, মহান আল্লাহ এটা বলেননি যে আমি আমার রহমত থেকে তাদেরকে দান করেছিলাম। বরং বলেছেন যে, তাঁদেরকে আমার রহমতের মধ্যে শামিল করে নিয়েছিলাম। অর্থাৎ তাঁদের দেহ ও মন-প্রাণকেই যেন খোদায়ী রহমত ঘিরে ফেলেছে ঠিক যেভাবে তাঁরা আগে নিমজ্জিত হয়েছিলেন সমস্যা ও সংকটের সাগরে।
দাউদ (আ) তালুতের পর ক্ষমতা পেয়েছিলেন। তিনি সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে খুব দূরদর্শিতা ও সূক্ষ্মদর্শিতা নিয়ে পরিচালনা করতেন। তার সন্তান সুলাইমান (আ)ও ছিলেন প্রজ্ঞা এবং হেকমাতের অধিকারী।
বিচারক হিসেবে দাউদ ও সুলায়মান নবী সম্পর্কে একটি শিক্ষণীয় ঘটনার কথা এসেছে সুরা আম্বিয়ার ৭৮ নম্বর আয়াতে: মহান আল্লাহ বলছেন, ‘দাউদ ও সুলাইমানের কথা স্মরণ কর যখন তাঁরা শস্যক্ষেত্র সম্পর্কে বিচার করেছিলেন। তাতে রাত্রিকালে কিছু লোকের মেষ ঢুকে পড়েছিল ও ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছিল। আমি দেখছিলাম সেই বিচার।’
দুই ব্যক্তি এসেছিল দাউদ নবীর কাছে একটি বিরোধের নিষ্পত্তি করতে। তাদের একজন জানাল যে অপরজনের ভেড়া রাতের বেলায় তার ফলের বাগানে ঢুকে আঙ্গুরের পাতা ও আঙ্গুর খেয়ে ফেলেছে। দাউদ নবী (আ) বললেন, এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য সব ভেড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তথা ফল বাগানের মালিককে দিতে হবে। কিন্তু এ সময় শিশু সুলাইমান (আ) তাঁর বাবাকে বলল, হে আল্লাহর নবী! এ রায়টি বদলে দিন। দাউদ প্রশ্ন করলে পুত্র বিকল্প পন্থায় ক্ষতিপূরণের একটি প্রস্তাব দেন।
শিশু নবী সুলাইমান বললেন: যেহেতু ভেড়া বাগান মালিকের কেবল ফসল বা লাভের অংশটুকু বিরাণ করেছে, মূল ক্ষেত বিনষ্ট করেনি তাই ভেড়ার পালের মালিকও ভেড়াগুলোকেই ক্ষতিপূরণ হিসেবে না দিয়ে বাগান মালিককে এক বছর পর্যন্ত ভেড়ার দুধ ও পশম দিতে পারে। আর এভাবে বাগানের ক্ষতিও পুষিয়ে যাবে এবং ভেড়ার মালিকও তার সমস্ত পুঁজি হারাবেন না।
পরের আয়াতেই মহান আল্লাহ সুলাইমানের বিচারকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন: আমরা সুলাইমানকে বিচারের সঠিক রায়টি কী হওয়া উচিত তা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। মহান আল্লাহর স্বীকৃতির আলোকে সুলাইমান (আ) ওই বিবাদ মীমাংশার জন্য চমৎকার প্রস্তাব পেশ করেন।
পরবর্তী আয়াতে সুলাইমান ও দাউদ (আলাইহিমুসসালাম) যে আল্লাহর রাসুল ছিলেন তা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলছেন: আমি সুলাইমান ও দাউদকে হিকমত আর প্রজ্ঞা দান করেছিলাম।
এরপর দাউদের প্রতি আল্লাহর আরো একটি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে:
পাহাড় ও পাখিও দাউদ (আ)’র প্রার্থনার সময় এ মহান নবীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আল্লাহর তাসবিহ পড়ত। এটা ছিল দাউদ (আ)’র নবুওতের প্রমাণ বা নিদর্শন সংক্রান্ত মু’জিজা তথা অলৌকিক ঘটনা।
হযরত দাউদ (আ) একজন নিভৃতচারী আবেদের মত কেবল দোয়া ও নামাজেই ব্যস্ত থাকতেন না, একইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন বড় মুজাহিদ এবং তিনি নিজ মুজাহিদদের জীবন রক্ষার জন্য বর্ম তৈরি করতেন। তিনি লোহাকে গলিয়ে নরম করে রিংয়ের মত বাঁকিয়ে চক্র বা বৃত্ত তৈরি করতেন এবং সেইসব লোহার বৃত্তগুলো মালার মত জোড়া দিয়ে বর্ম বানাতেন। সুরা আম্বিয়ার ৮০ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘আমি তাঁকে তথা দাউদকে তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণের কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। তাই তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে?’
সুরা আম্বিয়ার ৮৭ ও ৮৮ নম্বর আয়াতে হযরত ইউনুস নবীর (আ) ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ মহান নবী বহু বছর ধরে মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান। কিন্তু খুব কম মানুষই তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। ফলে তিনি ক্রুদ্ধ হন এবং নিজ জাতিকে অভিশাপ দিয়ে সেই জনপদ থেকে বেরিয়ে যান। বলা হয় যে অভিশাপ দেয়ার কয়েক দিন পরও আল্লাহর আজাব আসেনি। কারণ, তারা কিছুটা পরে হলেও তওবা করে। আর আল্লাহ তাদের তওবা কবুলও করেন। অবশ্য তাদের তওবার কথা বা তওবার সিদ্ধান্তের কথা ইউনুস (আ) জানতেন না। এ অবস্থায় লজ্জিত হন এই মহান নবী। তাই তিনি ওই এলাকা ছেড়ে চলে চান। কিন্তু রিসালাতের মিশন বা দায়িত্ব ত্যাগ করায় আল্লাহ তাকে কঠিন পরিস্থিতির শিকার করেন।
হতাশ ইউনুস (আ) যখন কিশতিতে ওঠেন তখন একটি তিমি ওই কিশতিতে হামলা করে। কিশতির আরোহীরা তাদের মধ্যে কোনো এক ব্যক্তিকে সাগরে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে ওই তিমি তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয় ও নৌকার ওপর হামলা বন্ধ করে। এ ব্যাপারে লটারিও করা হয়। লটারিতে প্রথমবার হযরত ইউনুসের নাম ওঠে। কিন্তু উনাকে একজন ধার্মিক ও বিনয়ী মানুষ মনে করে আবারও লটারি করে নৌকার লোকেরা। কিন্তু দ্বিতীয়বারও তাঁর নামই ওঠে। তৃতীয় বারও লটারিতে তাঁর নাম ওঠার পর ইউনুস নবীকে সাগরে ফেলে দেয়া হয়। ফলে ওই তিমি তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মহান আল্লাহর নির্দেশে তিমি তাঁকে হজম করেনি।
ইউনুস (আ) তিমি মাছের অন্ধকার ও সংকীর্ণ উদরে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে নিজের অধৈর্যের কথা স্বীকার করেন এবং মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। দয়াময় আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন এবং তাঁকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দেন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/ ১৭