দেখব ঘুরে ইরান এবার: শুমাল,গিলান, অস্তরা, আনজালি
গিলান নামটি এসেছে ‘গিল’ থেকে। অবশ্য গিলান প্রদেশের নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো গবেষকের মতে এই এলাকায় ‘গেলায়ি’ নামের একটি গোত্রের বসবাস ছিল। কেউ কেউ আবার এই গিলায়ি’কে বলছেন ‘গেল্’ গোত্র। তো গিলায়ি কিংবা গেল্ যা-ই হোক না কেন এই গোত্রের নামের সাথে মিল রেখেই এলাকাটির নাম হয়ে গেছে গিলান।
ফার্সি ভাষায় ‘গেল্’ এর বহুবচন হলো গেলান। আর সময়ের বিবর্তনে এই গেলান’এরই পরিবর্তিত নাম হয়ে গেছে গিলান। গবেষকদের মধ্যে যাঁরা মনে করেন ‘গেল্’ শব্দ থেকে গিলান নামকরণ করা হয়েছে, তাঁদের ভাষ্য হলো এই এলাকাটি ছিল সাধারণত জলাভূমি বা কর্দমাক্ত। রাশিয়ান বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ‘আলেক্সান্দার খোদেস্কু’ নিজেও এই মতের পক্ষে। তিনি তাঁর ‘গিলান ভূমি’ নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ এই প্রদেশের নাম –যাকে এই এলাকার লোকজন কখনো কখনো ‘গিল্’, কখনোবা গিলান আবার অনেক সময় গিলানাত নামে অভিহিত করে থাকে-সেই এলাকাটি মূলত জলাভূমি। গেল্ শব্দটেই মূলত এই এলাকার স্থানীয় জনগণের নিজস্ব উচ্চারণে ‘গেল্’ হয়ে গেছে। আর গিলান কিংবা গিলানাত দুটো শব্দই এই নামটির বহুবচন। আসলে বাস্তবেও কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী এই ভূখণ্ডটি ইরানের উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকার তুলনায় খানিকটা নীচু।

‘আলেক্সান্দার খোদেস্কু’ আরো বলেছেনঃ অসংখ্য বহতা নদীর জল এসে এই এলাকাটিকে ভিজিয়ে তৃপ্ত করে দিয়ে যায়, পূর্ণ করে দিয়ে যায় পুরো পরিবেশটাকে। কাস্পিয়ানের তীরবর্তী পর্বতগুলো থেকে নদীগুলো জন্ম লাভ করেছে। যেহেতু কাস্পিয়ানের পাশ্ববর্তী গিলান একটি সমতলভূমি, অন্তত ঢালু এলাকা খুব কম সেহেতু নদীর পানি হুট করেই বয়ে যেতে পারে না। আর সেজন্যেই এলাকাটির তৃষ্ণা মিটিয়ে দিয়ে যেতে পারে এইসব নদীর জল।’
ইরানের সবুজ শ্যামল প্রকৃতির প্রদেশ গিলান ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় সাহসী, বীরত্বপূর্ণ ও নির্ভীক হৃদয়ের মানুষের এলাকা ছিল। পর্বতগুলোর পাদদেশ থেকে শুরু করে সেই বৃক্ষ সুশোভিত সু উচ্চ পর্বতচূড়া পর্যন্ত অঞ্চল, জল টৈটুম্বুর নদীমালা ইত্যাদি পরিবেষ্টিত চমৎকার ভূখণ্ড এই গিলানে বসবাস করেছেন অকুতোভয় বীর সংগ্রামীরা। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে এই এলাকার লোকজন ছিল যুদ্ধ বা সংগ্রামের ক্ষেত্রে ব্যাপক অভিজ্ঞ ও বিস্ময়কর কৌশলী। তারা বৃক্ষময় এইসব জঙ্গলে কিংবা পার্বত্য উঁচু নীচু পরিবেশের মাঝে আশ্রয় নিয়ে নিশ্চিন্তে, স্বাধীনভাবে বসবাস করতেন। গিলান ভূখণ্ড সম্পর্কে যে বা যাঁরাই গবেষণা করেছেন তারাই একথা অকপটে বলে গেছেন যে, সেই প্রাচীন যুগের ইতিহাসবিদ বা গবেষক থেকে শুরু করে ইসলামী যুগ এবং ইসলাম পরবর্তী বিভিন্ন যুগের গবেষক একেবার আধুনিক পর্যন্ত সবাই একথা স্বীকার করেছেন যে, গিলানীরা খুব সাহসী ও অকুতোভয় বীরের জাতি। তারা ছিল খুবই স্বাধীনচেতা মনোভাবের অধিকারী। সেজন্যেই তারা কখনোই বিদেশীদের কাছে মাথানত করতে রাজি হয় নি। এ রকমই বীরত্বপূর্ণ কিছু সংগ্রামী ঘটনার প্রতি আমরা সংক্ষিপ্ত নজর বুলানোর চেষ্টা করবো।
ইরানের অপরাপর প্রদেশগুলোর মতো গিলান প্রদেশটিও বিভিন্ন রকম এলাকায় বিভক্ত। যেমনঃ শহর উপশহর, বিভিন্ন বিভাগ, গ্রাম এবং পল্লী ইত্যাদি। এখানকার এলাকাগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হলো ভাষাগত দিক থেকে এই এলাকাগুলো বা গোত্রগুলোর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। রয়েছে এই চার অঞ্চলের স্থানীয় ও গোত্রীয় পৃথক পৃথক ইতিহাসও। গিলানের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষিকাজ, পশুপালন, মাছ শিকার এবং মধুর চাষ। এর বাইরেও রেশমের চাষ এখানকার অর্থকরী একটি পেশা। গিলানে যেসব কৃষিপণ্য বেশি বেশি উৎপন্ন হয় সেগুলো হলো ধান এবং চা। লাহিজান এবং রুদসারসহ গিলানের বিভিন্ন শহরে এগুলোর চাষ হয়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এখানে রয়েছে, সেটা হলো যেইতুন বা অলিভ। রুদবার উপশহরে এর ফলন ব্যাপক পরিমাণে হয়ে থাকে। মাছ শিকারের জন্যে গিলানের তিনটি এলাকা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। একটি হলো বন্দর অস্তরা’, অপরটি হলো বান্দর কিয়শাহর এবং তৃতীয়টি হলো বন্দর আনযালি। আর মধু চাষের জন্যে গিলানের আশকেবার উঁচু এবং আশকেবার নিচু, আম্মরলু, দেইলামন এবং তালেশ-এই কটি এলাকা বেশ নামকরা।
পশুপালন হয়ে থাকে পাহাড়ের পাদদেশীয় এলাকায়। গম, যব, চিনা বাদাম, তামাক এবং হেযেল্নাট -যাকে ফার্সিতে ফানদোক বলা হয়, এগুলো বাদাম জাতীয় তবে তেলবহুল একধরনের শস্যদানা-এইসব পণ্যও খুব বেশি উৎপাদিত হয় প্রায় সমগ্র গিলানজুড়ে। ক্যাভিয়ার আরেকটি মূল্যবান খাদ্যবস্তু যা প্রচুর পরিমাণে এখানে পাওয়া যায়। ক্যাভিয়ার হলো মাছের ডিম। দেখতে শাগুদানার মতো তবে কালো রঙের। মাছ শিকারীদের মাধ্যমেই এই মূল্যবান পণ্যটি পাওয়া যায়। ক্যাভিয়ারের বেশিরভাগই রপ্তানী করা হয় ইরানের বাইরে। ইরানের রপ্তানীযোগ্য পণ্যের মধ্যে ক্যাভিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। গিলানের গ্রামীণ বা উপজাতীয় সমাজে এইসব বিচিত্র পেশার পাশাপাশি আরো একটি পেশার প্রচলন রয়েছে। সেটা হলো হস্তশিল্প। আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্যের কারণেও এখানে স্বাভাবিকভাবেই এইসব হস্তশিল্পের প্রচলন গড়ে উঠেছে।
গিলানের ধান চাষীরা প্রতি বছরই মাত্র পাঁচ মাস কৃষিকাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ধান বোণা থেকে ধান কাটা পর্যন্ত সময়টুকুতেই তারা একাজে ব্যস্ত থাকে। বাকি লম্বা সময় ধরে কৃষিজীবীগণ তাদের আর্থিক যোগানের জন্যে হস্তশিল্প সামগ্রী বোণা বা তৈরির কাজে সময় দেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ করার মতো, তা হলো প্রাচীনকালে গিলানে এমন কিছু শিল্পের প্রচলন ছিল যেগুলোর ততোটা কদর বা প্রচলন এখন আর নেই। যেমন খোদাই শিল্প, কাঁচ শিল্প এবং ধাতব শিল্প। বিভিন্ন গবেষণায় এগুলোর সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কথা প্রমাণিত হয়েছে।প্রফেসর গ্রিসম্যানের লেখাতেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন তৈজস এবং মাদুর তৈরির ক্ষেত্রেও গিলানের ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ বলে বিভিন্ন জনের লেখায় উঠে এসেছে। গবেষকদের অনেকর মতেই পাথর খোদাই শিল্পের পরই যে শিল্পটির সাথে মানব সমাজের পরিচিতি ঘটেছে তা হলো এই তৈজস আর মাদুর তৈরি শিল্প। এই মাদুর বোণার সূত্র ধরেই জন্ম নিয়েছে কাপড় বোণা, গেলিম বোণা ইত্যাদির মতো বুনন শিল্প।
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/১৭