মে ২১, ২০১৭ ১৮:২৭ Asia/Dhaka

আজ গিলানের হস্তশিল্প সামগ্রীর মধ্য থেকে মৃৎ শিল্প নিয়ে কথা বলা যাক। ইংরেজিতে এই শিল্পকে পটারি বলে অভিহিত করা হয়। বেশিরভাগ গবেষক এবং পুরাতত্ত্ব বিশ্লেষকদের মতে এই পটারি বা মৃৎশিল্পের সূতিকাগার হলো ইরান। তার মানে হলো মৃৎশিল্পের প্রচলন ইরান থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে বলে তারা বিশ্বাস করেন।

এই শিল্পটি মানব জাতির পক্ষে উৎপাদিত  সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পের নিদর্শন। বলা হয়ে থাকে যে আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে এই শিল্পটি গড়ে উঠেছে। হস্তশিল্পের বিভিন্ন শাখার মাঝে এই মৃৎশিল্পটির একটা বিশেষ মূল্য ও গুরুত্ব রয়েছে। জন শেইফলি নামের মার্কিন এক লেখক ‘ইরানের শিল্প পর্যালোচনা’ নামে একটি বই লেখেন। ঐ বইতে তিনি মৃৎশিল্পের অবস্থান বা মর্যাদাকে অন্যান্য হস্তশিল্পের ওপরে স্থান দিয়েছেন। 


মার্কিন ইরান বিশেষজ্ঞ জি গ্লাক মৃৎশিল্প নিয়ে গবেষণা করার জন্যে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছেন। গিলানের মৃৎশিল্প নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁর ‘ইরানী হস্তশিল্পের ভূবনে’ নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ

গিলানে, নারীরাই মৃৎশিল্পের সকল কাজ এমনকি নকশার কাজটিও করে। পুরুষরা বিভিন্ন তৈজস বা পাত্র তৈরি করার জন্যে কাদামাটির মশলা তৈরি করে দেয় আর নারীরা সেই কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন তৈজস বা শিল্প সামগ্রী তৈরি করার পর সেগুলোকে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে। প্রাগৈতিহাসিক কালের গিলানের মৃৎশিল্পের নিদর্শনগুলো এতোই চমৎকার, অনন্য এবং চিত্তাকর্ষক যে, খুব কমই এগুলোর জুড়ি মিলেছে। এগুলোর গুণমান এতো উন্নত হবার কারণ হলো স্থানীয় মাটির উন্নত বৈশিষ্ট্য। এখানকার কাদামাটির একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো মাটি বেশ হালকা এবং কম তাপেই এগুলোকে পোড়ানো যায়। 

Image Caption

গিলানের মৃৎ শিল্পের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো ব্যাপক বৈচিত্র্য। আজকাল গিলানে যেসব মৃৎ শিল্পের কাজ হয় সেগুলোকে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীতে পড়বে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, বাড়ির ছাদে ব্যবহারের জন্যে তৈরি টালি। দ্বিতীয় শ্রেণীর মৃৎ শিল্পের উদাহরণ হলো আলঙ্কারিক গুণ সম্পন্ন বিচিত্র শৈল্পিক জিনিসপত্র। এই শ্রেণীর মৃৎ শিল্পের জন্যে মেধা এবং সৃজনশীল প্রতিভার প্রয়োজন রয়েছে। গিলানের মৃৎশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোর চকচকে ভাবটা নেই। গিলানী মৃৎ শিল্পীরা সাধারণতত তাদের কাজে নিকেলের মতো চকচকে রং ব্যবহার করেন না। তাঁরা বরং নিজেদের কাজের মৌলিকতার ওপরই বেশি বেশি জোর দেন। তবে যেসব ক্ষেত্রে চকচকে রঙের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী, সেসব ক্ষেত্রে সবুজ রংটি ব্যবহার করা হয়। এর কারণ হলো গিলানের প্রকৃতির রঙের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখা।

বর্তমানে গিলানের প্রায় বেশিরভাগ এলাকাতেই মৃৎ শিল্পের চর্চা হচ্ছে। বিশেষ করে আসা’লেম, লাহিজান, রুদসার, লাংরুদ, রাশ্‌ত, তলেশ, সৌমে সারা’, অস্তরা’ এবং সিয়াহকাল এলাকায় এই শিল্পটির চর্চা ব্যাপকভাবে চলে আসছে। আসালেমে কাদামাটির উন্নত বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার মৃৎ শিল্প সামগ্রীর বেশ নামডাক রয়েছে। এই এলাকার মৃৎ শিল্পের ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। বলা যেতে পারে এই ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন।

Image Caption

 

গিলান প্রদেশে জঙ্গল থাকায় এবং জঙ্গলে প্রচুর গাছ গাছালি থাকার কারণে এখানে বহু কাঠ উৎপন্ন হয়। আর কাঠের পর্যাপ্ততার কারণে এই প্রদেশে সুন্দর সুন্দর জিনিসের পরিমাণও চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে কাঠের ওপর নকশা করার মতো সূক্ষ্ম শিল্পের প্রচলন এখানে ব্যাপকভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কাঠ খোদাই করেও বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। যেমন ফুলদানি, কান্দন অর্থাৎ চারকোণা জমাট চিনির টুকরো যা চায়ের সাথে চিনির পরিবর্তে খাওয়া হয়-সেগুলো রাখার পাত্র, চকোলেট রাখার পাত্র, শুকনো ফল, বাদাম বা শস্যদানা জাতীয় খাদ্য, বুট, চানাচুর, ভাজা খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি রাখার পাত্র এবং খাবারের পাত্র, সিগারেট অ্যাশ্ট্রে, নলচে, নল এবং এ জাতীয় আরো বহু জিনিসপত্র এখানে তৈরি হয়। এগুলো তৈরি করতে ছোটো বড়ো অনেক সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ে। একজন কাঠমিস্ত্রিীর যতোগুলো যন্ত্রের দরকার একজন কাঠ শিল্পীরও ততোগুলো সরঞ্জাম দরকার পড়ে। রাশত শহরে এই কাঠনির্মিত শিল্পের চর্চা বেশি হয়ে থাকে।

পশমি বস্ত্র তৈরি এই গিলান এলাকার অপর একটি প্রধান হস্তশিল্প। এটি গিলানের প্রাচীনতম হস্তশিল্পগুলোর একটি। প্রাচীন যুগ থেকেই এই শিল্পটি গিলানে প্রচলিত ছিল এবং এখনো একইভাবে প্রচলিত আছে। পশম দিয়ে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। যেমন মাদুর, গালিচা, পোশাক, হ্যাট ইত্যাদি। গিলানে এইসব পশমি শিল্প অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি ব্যবহার করা হয়। পশমি শিল্পের প্রতি গিলানের জনগণের এতো বেশি আগ্রহের কারণ হলোঃ এই পশমি সামগ্রি আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে খুবই উপযোগী। কেননা এর মূল উপাদানটাই হলো পশম। গ্রামবাসীরা, বন জঙ্গলের অধিবাসীরা এবং যারা পশুপালন করে তারাও শীত এবং বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে গায়ের ওপর জড়ানোর উপযোগী এক ধরনের পোশাক তৈরি করে এই পশম দিয়ে। যেহেতু ঘাড়ের ওপরেই পশমি ঐ লেবাসটি পরা হয়, সেজন্যে গিলানের বেশিরভাগ এলাকায় এটি ‘দুশি’ নামেই পরিচিত। ফার্সি দুশ মানে ঘাড়। ঘাড়ের ওপর পরার কারণে পশমি এই পোশাকটির এমন নাম।

পশমি হস্তশিল্প ছাড়াও গিলানের আরো কটি বিখ্যাত শিল্পের মধ্যে রয়েছে হাতে বোণা রেশমি বিভিন্ন সামগ্রী এবং সূতার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী। গিলানের রেশমি সূতোয় বোণা সামগ্রী রং এবং বুণনের দিক থেকে বিস্ময়কর সুন্দর। কাপড়ের ওপরে নকশা তৈরির কাজের বেলাতেও গিলানের অবস্থান অনেক উর্ধ্বে। বিশেষ করে এখানকার রাশত উপশহরটিতে এই শিল্পের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে ইদানিং অবশ্য ততোটা জাকজমক আর নেই।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২১