দেখব ঘুরে ইরান এবার: আনজালি বন্দর
ইরানের শুমলে অবস্থিত বন্দরগুলোর মধ্যে বান্দার আনযালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর তিনদিকে রয়েছে সমুদ্র এবং জলাভূমি আর একদিকে রয়েছে স্থলভূমি। বন্দরটির আয়তন চল্লিশ বর্গ কিলোমিটারের মতো। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলে পড়েছে বন্দরটি। গিলান প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর রাশত থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে আর তেহরান থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দূরে পড়েছে বান্দারে আনযালি।
এ এলাকার আবহাওয়ার ওপর কাস্পিয়ান সাগর এবং আলবোর্য পর্বতমালার উচ্চতাসহ সমুদ্রের উত্তর উপকূলবর্তী বাদবাকি এলাকারও প্রভাব পড়েছে, সেজন্যেই এখানকার আবহাওয়া আর্দ্র এবং নাতিশীতোষ্ণ। আনযালি উপসাগরের অস্তিত্ব নৌকা বা জাহাজগুলোর নোঙর করার জন্যে কিংবা মাছ শিকারের জন্যে খুবই উপযোগী এবং নিরাপত্তার কারণ হয়েছে। কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী দেশগুলোর সাথে ইরানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যে আনযালি বন্দরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর। বাণিজ্যিক উন্নয়ন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্যে এই বন্দরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

আনযালি বন্দরটি মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির বাইরেও ইরানের শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে এমনকি ইরানের জনবহুল একটি এলাকা হিসেবেও বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। এই বন্দরটি কাস্পিয়ান সাগরের উত্তর উপকূলীয় অপরাপর বন্দরগুলোর সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেই কেবল নয় বরং কৃষ্ণ সাগর, ভলগা ক্যানেলের মাধ্যমে ইউরোপেরও বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক এবং বাণিজ্যিক বন্দরগুলোর সাথে যোগাযোগের সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে এই বন্দরের সাহায্যে। এ কারণে আনযালি বন্দরটিকে ইউরোপের দরোজা বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। আনযালি অঞ্চলের লোকজনের পেশার মধ্যে মাছ শিকারটাই অন্যতম। এর বাইরেও কৃষিকাজ, হস্তশিল্প সামগ্রি তৈরির কাজও হয়ে থাকে প্রচুর। কৃষিকাজের মধ্যে ধান চাষ, রেশম পোকার চাষ এগুলোর চাষ একটু বেশি। আনযালি এবং তার আশপাশের শহরগুলোতে রেশম পোকার প্রচলন রয়েছে। জালবোণাসহ কাঠের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতেও এখান জনগণ বেশ সুন্দর সুন্দর বহু জিনিস তৈরি করে। এগুলোর বেশিরভাগই এখানকার লোকজন হাতেই তৈরি করে। আনযালি বন্দর নৌকা তৈরি করার ব্যাপারেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

আনযালি উপশহরে দেখার মতোও আছে অনেক কিছু। মিয়ন পোশতে প্রাসাদ বা সামরিক যাদুঘর এখানকার একটি দর্শনীয় নিদর্শন। আরো রয়েছে ঘড়ি টাওয়ার, বন্দর জেটি এবং মিনার বা সামুদ্রিক ফানুস ইত্যাদি। আনযালির শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাগুলোর মাঝে মেরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট সুনাম সুখ্যাতি রয়েছে। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘খোশতরিয়া’ প্রাসাদের ওপর মিয়ন পাশতে প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। এই প্রাসাদে ১১টি কক্ষ আছে এবং একটি অভ্যর্থনাগার আছে। অভ্যর্থনা কক্ষটি বেশ সুন্দর করে সাজানো। এই কক্ষটি এখন সামরিক যাদুঘর হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। সাফাভি শাসনামল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সময়কার বহু ধরনের অস্ত্র শস্ত্র এই যাদুঘরে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো বন্দর আনযালির এমন একটি ভবনে এই যাদুঘরটি বানানো হয়েছে যেই ভবনটি নিজেই শিল্প ও স্থাপত্যকলার একটি যাদুঘরের মতো।

আনযালি ঘড়ি টাওয়ারটি আনযালি স্কোয়ারের উল্টা দিকে অবস্থিত। আনযালি স্কোয়ারকে সেপাহ বাজারও বলা হয়ে থাকে। এই বাজারটি বেশ পুরোণো। বলা হয়ে থাকে ১৮১৫ সালে এই বাজারটি গড়ে উঠেছিল। বাজারটির উচ্চতা ২৮ মিটার। সমুদ্রের বাতিঘরের মতো দেখতে এই ভবনটি আনযালির উপকূলবর্তী একেবারে সমুদ্রের বুকে যেন দাঁড়িয়ে আছে- এরকমই মনে হয়। এই বাতিঘরটি নাসির উদ্দিন শাহ কাজারের আমলে নির্মিত হয়েছিল। তৎকালীন শাসক খসরু খান গোর্জি সমুদ্রচারীদের পথনির্দেশনা দেওয়ার লক্ষ্যে এই টাওয়ারটি তৈরি করেছিল। টাওয়ারের ওপর যে আগুন জ্বলতো তেলের সাহায্যে ঐ বাতিটা জ্বালানো হতো। ১৯২৮ সালে এই টাওয়ারটি মেরামত করার পর ঐ টাওয়ারটির ওপরে চতুর্মুখি চারটি ঘড়ি স্থাপন করা হয়। এই পরিবর্তন বা মেরামতের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেগুলো ঠিকঠাক মতো কাজ করছে।

জলাভূমি বা আনযালির পুকুরও গিলান প্রদেশের পর্যটক আকর্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আনযালি উপশহরের কাছেই কিংবা বলা যায় কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে এটি অবস্থিত। নীলপদ্ম আর সবুজ বাঁশের মতো নলখাগড়ার ঝাড়ে ঢাকা খাল নালাগুলো কী যে চমৎকার একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে তা না দেখলে উপলব্ধি করা কঠিন। এর বাইরেও আছে পাখপাখালির কিচির মিচির, আশেপাশে রয়েছে ছোট ছোট গ্রাম আর ছোট ছোট দ্বীপ। এইসব মিলিয়ে আনযালি জলাশয়গুলোকে চমৎকার একটি পর্যটন এলাকায় পরিণত করেছে।

নল খাগড়ার ঝাড়ের কথা বলেছি একটু আগেই। সাধারণত খালের পাড়েই অর্থাৎ স্বল্প গভীর জলাশয়ের পাড়েই এগুলোর জন্ম হয়। এই আনযালি এলাকাটিও ঠিক তেমনি কম গভীর জলের এলাকা। সেজন্যে নল খাগড়ার পাশাপাশি এখানে ঘাস লতাগুল্মও বেড়ে ওঠে। এগুলো অবশ্য মৌসুমি অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী। একটি ঋতুতে জন্মে আবার আরেক ঋতুতে মরে যায়। আইন অনুযায়ী এইসব এলাকায় অবশ্য পাখি শিকার করা, মাছ ধরা, গাছ কাটাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুকুরের পূর্ব পাড়ের বেশিরভাগ এলাকাই নলখাগড়ায় পুরোপুরি ঢাকা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ইরানের উদ্দরাঞ্চলীয় ‘রমসার কনভেনশানে’ আন্তর্জাতিক জলাশয়ের তালিকায় আনযালি জলাশয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এইসব জলাশয়কে তাই যত্নের সাথে সংরক্ষণ করা উচিত।
আনযালি জলাশয় বিচিত্র প্রজাতির অতিথি পাখির জন্যে বেশ নিরাপদ। বিদেশী বহু প্রকারের পাখি বিশেষ করে শীত ঋতুতে বসবাস করার নিরা

পদ স্থান হিসেবে এই আনযালিকে বেছে নেয়। হাঁস জাতীয় পাখিরা যেমন আসে এখানে তেমনি বিচিত্র রকমের গাঙচিলও আসে। আনযালি জলাশয়ে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদও আছে। এইসব উদ্ভিদের মাঝে পদ্মফুল- যাকে ভাসমান উদ্ভিদ প্রজাতির বলে ধরা হয়-এগুলো বিশেস একিট পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দেখলেই একেবারে মন জুড়িয়ে যায়। নৌকায় করে জলাশয়ে বেড়ানোর সময় পদ্মফুলের চমৎকার পাতাগুলো যে কতো সুন্দরভাবে পানির ওপরে ভেসে থেকে অপূর্ব পরিবেশ রচনা করে সেটা চোখে না দেখলে বুঝানো মুশকিল। এইসব সবুজ পাতার ওপর ফুটে থাকা পদ্মফুলগুলো সত্যিই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ টি-৬১