জুন ০৮, ২০১৭ ১৫:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: রুদবর গিলান

‘রুদবর’ শহরটিও গিলানের মধ্যে একটি সবুজ শ্যামল এলাকা। যেইতুন গাছ বা অলিভ গাছের সবুজে ঘেরা এই শহরটি। আর খনিজ জলের ধারাও রয়েছে প্রচুর। এখানে আরো রয়েছে ঐতিহাসিক মারলিক টিলাগুচ্ছ। এই টিলাগুলো রুদবর শহরটির মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের ভেতর থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও বহু মানুষ এই শহরটি দেখতে আসে।

রুদবরের কেন্দ্রিয় শহরের নামও রুদবর। গিলানের একটি পার্বত্য উপকূলীয় অঞ্চল এটি। আলবোর্য পর্বতমালার পাদদেশে পড়েছে রুদবর। শহরটি সেফিদরুদ এবং তার আশপাশের এলাকা জুড়ে বিদ্যমান যেইতুন বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অবস্থিত। এই এলাকার অর্থনীতি পশুপালন আর কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। তবে রুদবরের প্রধান উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মধ্যে যেইতুন অন্যতম। এই যেইতুন থেকে তৈরি হয় সাবান এবং তেল জাতীয় দ্রব্য।

রুদবর

রুদবর এলাকাটিকে গিলানের একটি প্রাচীনতম আবাসভূমি বলা যেতে পারে। সেফিদরুদের পূর্ব তীরে গওহার রুদ নামে চমৎকার একটি উপত্যকা রয়েছে। মাটির উর্বরতা, উপভোগ্য আবহাওয়া, আর্দ্রতা আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্যে এই এলাকাটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে উত্তম এলাকা হিসেবে পরিগণিত। গওহার রুদ উপত্যকার মাঝে একটি নদী আছে গওহার রুদ নামেই। এখানে ছোটো বড়ো বেশ কয়েকটি টিলাও নজরে পড়বে। এগুলো বেশ প্রাচীন। মার্লিক টিলাসহ গওহার রুদের প্রাচীন টিলাগুলো তাদের বুকের গহীনে বিস্মৃত সেই প্রাচীন সভ্যতার বহু নিদর্শন আগলে রেখেছে। মার্লিক টিলা মানব সভ্যতা ও শিল্পের বহু মূল্যবান অনেক সম্পদ শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে লুকিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর।

১৯৬১ এবং ১৯৬২ সালে পুরাতত্ত্ব বিভাগ এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় মার্লিক টিলায় পুরাতাত্ত্বিক গবেষকগণ খনন কাজ চালিয়েছিলেন। তাদের ওই গবেষণায় খুলে গেছে ভুলে যাওয়া প্রাচীন ইতিহাসের বহু পাতা। সেখানে দেখা গেছে বিস্মৃত অনেক গোত্রের কবরস্থান। অনেকের ধারণা এই টিলাটিতে বিশেষ ব্যক্তিদের দাফন করা হতো। বিশেষ করে স্থানীয় শাসকগণ এবং রাজপুত্ররকেই এখানে সমাহিত করা হতো। ধারণা করা হয়ে থাকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে কিংবা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে এইসব রাজপরিবার শাসনকাজ চালিয়েছিলেন।

রুদবর গ্রাম

সেইসাথে আরো মনে করা হয়ে থাকে যে, সে সময়কার রীতিনীতি অনুযায়ী মৃতদের সাথে তাদের ব্যবহৃত মূল্যবান সকল জিনিসপত্রও মাটিতে পুঁতে রাখা হতো।

তো এইসব টিলায় গবেষণামূলক খননকাজ চালিয়ে প্রায় পঁচিশটা কক্ষ পাওয়া গেছে। সে সময় কবরগুলোকে কক্ষের মতো করে বানিয়ে লাশগুলো দাফন করা হতো। আর সেইসব কক্ষে রেখে আসা হতো স্বর্ণ, রৌপ্য, ধাতব, পিতল, ব্রোঞ্জের বিচিত্রসব জিনিসপত্র। তলোয়ার থেকে শুরু করে মাথার তাজ আর খাবার তৈজস থেকে শুরু হয়ে সাজসজ্জার অলঙ্কার সামগ্রী পর্যন্ত সবকিছু। তাদের জীবন যাপন প্রণালী আর সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে বোঝা যায় যে তারা মৃত্যু পরকালীন জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। মার্লিক টিলায় যেসব কাপড়ের নমুনা মিলেছে সেগুলোতে দেখা গেছে গিলানে বুনন শিল্পের আবির্ভাব ও উন্নয়ন সর্বোপরি এই শিল্পের বয়স কয়েক হাজার বছর। গবেষকদের গবেষণায় আরো যে মজার বিষয়টি আবিষ্কৃত হয়েছে তা হলো একটি সিল-মোহর। ঐ মোহরটির ওপর কিউনিফর্ম বা সহজ করে বলা যায় পেরেকের মতো অক্ষরের লেখা দেখতে পাওয়া গেছে। আরেকটি মোহরে দেখা গেছে শিকারের চিত্র। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে এগুলো অন্তত তিন হাজার বছর আগের নমুনা।

মার্লিক টিলা

এখানে আরো যে জিনিসটি আবিষ্কৃত হয়েছে তাহলো পানপাত্র। এটি একটি অনন্য আবিষ্কার। মার্লিক পেয়ালা বা পানপাত্র হিসেবেই এগুলো পরিচিতি লাভ করেছে। এই পানপাত্রগুলোর উচ্চতা আঠারো সেন্টিমিটার। আর এগুলোর নকশার উচ্চতা দুই সেন্টিমিটারের মতো। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে এই নকশাগুলো করা হয়েছে। তবে এগুলোর মসৃণতা এবং সৌন্দর্য দেখলে সহজেই অনুমান করা যাবে কতোটা দক্ষ ছিলেন সে সময়কার এই শিল্পীরা। পেয়ালার তলায় চমৎকার করে ফুলের নকশা করা হয়েছে। ঐ নকশার মাঝে সূর্যের নকশাও এমনভাবে অঙ্কিত হয়েছে যেন সূর্যের কিরণ সুন্দরভাবে বিকিরিত হচ্ছে। মার্লিকের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে সূর্যকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। সে কারণেই বেশিরভাগ পাত্রে এবং ধাতব পেয়ালায় সূর্যের চিত্র আঁকা হয়েছে। নকশাগুলোর দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে সূর্য হলো সবকিছুর কেন্দ্রমূলে।

লিলিউম লেদেবুরি

খ্রিষ্টপূর্ব ছয় হাজার বছর আগে মানুষ ধাতব বস্তু নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেও মার্লিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বা গর্বের বিষয়টি হলো ধাতব শিল্পে বিশেষ করে ব্রোঞ্জ শিল্পের ক্ষেত্রে। মার্লিক এলাকায় ধাতব পাথরের খনি থাকার কারণে এবং কাঠের মতো বিচিত্র জ্বালানী থাকার কারণে ব্রোঞ্জ শিল্পকেন্দ্রিক বহু কল কারখানা গড়ে উঠেছে। মার্লিকে আবিষ্কৃত অনন্য সাধারণ জিনিসগুলোর মধ্যে কাঁচের পানপাত্র সত্যিই বিস্ময়কর একটি বিষয়। বলা হয়ে থাকে যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে তৈরি কাঁচ শিল্পের সর্বপ্রথম নমুনা হলো মার্লিক অঞ্চলে আবিষ্কৃত এই কাঁচের জিনিসগুলো।

পানপাত্র

মার্লিকে যেসব তৈজসের নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সাজ সজ্জার মূল্যবান জিনিসপত্র, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র শস্ত্র, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, থালা বাটি বাসন কোসন, মাটির তৈরি ছোটো বড়ো বহু ভাস্কর্য এবং ধাতব বস্তুসামগ্রী। মূল্যবান এইসব দ্রব্যের বেশিরভাগই বর্তমানে ইরানের জাতীয় যাদুঘরের প্রাচীন ইরান বিভাগে সংরক্ষিত আছে। এই যাদুঘরটি ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত। এই তো গেল প্রাচীন তৈজসের কথা। এখানে অনন্য একটি উদ্ভিদও রয়েছে। এই উদ্ভিদের নাম হলো লিলিউম লেদেবুরি। এগুলোর উচ্চতা হলো পঞ্চাশ থেকে দেড়শ’ সেন্টিমিটার। এগুলো দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি ফুলগুলোও দেখার মতো। দশ থেকে পণেরোটা ফুল ধরে। এই উদ্ভিদটা সমগ্র গিলানের একটিমাত্র এলাকাতেই দেখতে পাওয়া গেছে। ইরানের বাইরে কেবলমাত্র আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের লাঙ্কারন শহরে দেখা গেছে। গিলানের রুদবর এলাকার ‘দমশ’ গ্রামে এই উদ্ভিদটি জন্মে। এই গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৮/৬৪