সুরা দুখান-এর প্রাথমিক পরিচিতি ও কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা দুখান পবিত্র কুরআনের ৪৪তম সুরা। তবে নাজিল হওয়ার কালক্রম অনুযায়ী এটি কুরআনের ৬৪তম সুরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় রয়েছে ৫৯আয়াত।
কুরআনের মহত্ত্ব, পবিত্র এক রাতে এর নাজিল হওয়ার ঘটনা, একত্ববাদ ও সৃষ্টি জগতে মহান আল্লাহর মহত্ত্বের নানা নিদর্শন এবং কাফেরদের পরিণতি ও শাস্তি সুরা দুখানের প্রধান কয়েকটি আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়াও ফেরাউন, হযরত মুসা (আ) ও বনি-ইসরাইলের কাহিনী, ফেরাউন ও তার দলবলের ধ্বংস হওয়া, সৃষ্টি জগতের অস্তিত্ব উদ্দেশ্যবিহীন না হওয়া,কিয়ামত ও দোযখবাসীদের শাস্তি এবং খোদাভীরুদের নানা পুরস্কার সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে এ সুরায়।
দুখান শব্দের অর্থ ধোয়া। এই সুরার দশম আয়াতে এসেছে এই শব্দ।
এবারে শোনা যাক সুরা দুখানের প্রথম পাঁচ আয়াতের অনুবাদ:
‘হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে,নিশ্চয়ই আমরা সব সময়ই সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয় আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে,আমিই নবী-রাসুল প্রেরণকারী।’
কুরআনের বাণী স্পষ্ট ও প্রকাশ্য, জীবন্ত ও গঠনমূলক এর শিক্ষা। বরকতময় এক রাতে নাজিল হয়েছিল এই মহাগ্রন্থ। আর সেই রাতটি চিরস্থায়ী সব কল্যাণ আর ভালো বিষয়গুলোর উৎস। বেশিরভাগ ব্যাখ্যাবিদদের মতে এখানে যে রাতটির কথা বলা হচ্ছে তা হচ্ছে মহিমান্বিত রজনী তথা শবে ক্বাদর। কুরআন নাজিল হওয়ার এই রাতটি মানবজাতির ভাগ্যকে করেছে স্বর্ণোজ্জ্বল সম্ভাবনায় প্রোজ্জ্বল। এ রাতের সমৃদ্ধিতে কুল-মাখলুকের প্রাণে জাগে অশেষ আনন্দের হিল্লোল।
সমগ্র কুরআন একবার রমজানের শবে ক্বাদরে এক দফায় নাজিল হয়। আর পর্যায়ক্রমে এর নানা আয়াত নাজিল হয় মহানবীর (সা) জীবনের নানা ঘটনা উপলক্ষে দীর্ঘ ২৩ বছরের পরিক্রমায়।
সুরা দোখানের ৮ থেকে ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
‘তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃ-পুরুষদেরও পালনকর্তা। এতদসত্ত্বেও এরা সন্দেহের শিকার হয়ে ক্রীড়া-কৌতুক করছে। অতএব আপনি সেই দিনের অপেক্ষা করুন,যখন আকাশ স্পষ্ট ধূয়ায় ছেয়ে যাবে যা মানুষকে ঘিরে ফেলবে। এটা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ওরা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা আমাদের উপর থেকে শাস্তি প্রত্যাহার করুন,আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি।’
সুরা দুখানের নয় নম্বর আয়াতে তাদের কথা বলা হচ্ছে যারা সত্যকে উপেক্ষা করে এবং তারা সত্যকে পরিহাস করে ও কুরআনের আর মহানবীর (সা) রেসালাতের সত্যতা সম্পর্কে গভীর সন্দেহ পোষণ করে।
এরপর সত্যের বিরুদ্ধবাদী এই গোঁড়া লোকদের হুমকি দিয়েছেন মহান আল্লাহ। আর এরপর মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলকে বলছেন, ‘অতএব আপনি সেই দিনের অপেক্ষা করুন, যখন আকাশ স্পষ্ট ধূয়ায় ছেয়ে যাবে যা মানুষকে ঘিরে ফেলবে। এটা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর তখন ওরা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা আমাদের উপর থেকে শাস্তি প্রত্যাহার করুন, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি।’ এখানে স্পষ্ট ধোয়া বলতে আকাশের সেই স্পষ্ট ধোয়ার কথাই বলা হচ্ছে যা কিয়ামতের প্রাক্কালে দেখা যাবে এবং তা গোটা আকাশকে ছেয়ে ফেলবে।
এটা হবে বর্তমান দুনিয়ার শেষ মুহূর্তের নিদর্শন। এ সময়ই জালিম ও পাপীদের ওপর খোদায়ী শাস্তি বাস্তবায়ন শুরু হবে। ফলে এ সময় কাফির, জালিম ও পাপীরা ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে। উদাসীনতার যে পর্দা পাপীদের চোখের সামনে ছিল তা এ সময় উধাও হয়ে যাবে। ফলে তারা এতদিনে তাদের কৃত মহাভুল বুঝতে পেরে শাস্তি সরিয়ে নিতে আল্লাহকে অনুরোধ করবে এবং ঈমান আনার কথা বলবে।কিন্তু তাদের এই অনুরোধের জবাবে মহান আল্লাহ বলবেন: ‘তারা কি করে বুঝবে, অথচ এর আগেও তাদের কাছে এসেছিলেন স্পষ্ট বর্ণনাকারী রসূল (যার বক্তব্য বা শিক্ষা ও কর্মসূচি ছিল স্পষ্ট)? এরপর তারা তাঁকে তথা রাসুলকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে এবং বলে, সে তো উন্মাদ! সে অন্যদের শেখানো কথা বলে! আমি তোমাদের ওপর থেকে আযাব কিছুটা কমিয়ে দেব, কিন্তু তোমরা আবারও আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।’ দুষ্টু বা মন্দ লোকদের স্বভাব হল তারা শাস্তি আসতে দেখলে অনুশোচনা করে ও সঠিক পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু শাস্তির লক্ষণ সরে যেতে দেখা মাত্রই আবারও অন্যায় ও পাপাচার শুরু করে। এরপর সুরা দুখানের ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:‘যেদিন আমি (কাফিরদের) প্রবলভাবে ধরব, সেদিন পুরাপুরি প্রতিশোধ নেবই।’-পাপী ও কাফিরদের জন্য যে কঠোর খোদায়ী শাস্তি অপেক্ষা করছে-এখানে তা-ই বলা হয়েছে। এর পরের কয়েক আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘তাদের আগে আমি ফেরাউনের সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি এবং তাদের কাছে এসেছেন একজন সম্মানিত রসূল, এই মর্মে যে,আল্লাহর বান্দাদেরকে তথা বনি-ইসরাইলকে আমার কাছে অর্পণ কর। আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত বিশ্বস্ত রসূল। আর তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করো না।
আমি তোমাদের কাছে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করছি।’এখানে নবী-রাসুলদের বাণী ও একত্ববাদকে অস্বীকারকারী অতীতের কাফির জাতিরগুলোর দৃষ্টান্ত হিসেবে মুসা নবী ও ফেরাউনের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। মুসা (আ) যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরে ফেরাউন ও তার দলবলকে সঠিক পথে আসার আহ্বান জানান যাতে তাদের অন্ধকার হৃদয় সত্যের আলোয় প্রোজ্জ্বল হয়। কিন্তু সত্যের আহ্বান তাদের হৃদয়ে কোনো প্রভাব ফেলেনি। ফলে খোদাদ্রোহী ও আধিপত্যকামী ফেরাউন আর তার দলবল সমুদ্রে ডুবে শোচনীয়ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
এভাবে বনি-ইসরাইল জুলুম এবং হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়।ফেরাউন ও তার দলবলের পরিণতিকে খুব শিক্ষণীয় ও আকর্ষণীয় ভাষায় তুলে ধরে মহান আল্লাহ সুরা দুখানে বলেছেন:‘তারা ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ,কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য স্থান। কত সুখের উপকরণ,যাতে তারা খোশগল্প করত। এমনিই হয়েছিল এবং আমি সেগুলোর মালিক করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। তাদের জন্যে কাঁদেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।’ #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ১৪