"যেদিন কোন বন্ধুই কোন বন্ধুর উপকারে আসবে না" : সুরা দুখান
সুরা দুখানের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি নভোমন্ডল, ভূমণ্ডল ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি; কিন্তু তাদের বেশিরভাগই বোঝে না।’
হ্যাঁ,এই বিশাল সৃষ্টি জগত বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়নি বলে মহান আল্লাহ এখান ঘোষণা করছেন। আমরা কিছু দিনের জন্য পৃথিবীতে থাকলাম,খেলাম, ঘুমালাম ও এরপর মরে গেলাম এবং তারপর আর যদি কিছুই না থাকে তাহলে তো এসবই হয়ে যায় অর্থহীন! মহাজ্ঞানী ও মহাকৌশলী আল্লাহ এ বিশ্বজগত ও সৃষ্টিকুলকে কেবল স্বল্পস্থায়ী জীবনের জন্য সৃষ্টি করেছেন-এমন ধারণা মহান আল্লাহ সম্পর্কে সুবিচার হতে পারে না।
সৃষ্টি-জগত নিয়ে যদি আমরা খানিকটা ভাবনা-চিন্তা করি তাহলে এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে এই বিশ্ব-জগত আরও এক বড় ও চিরস্থায়ী জগতে যাওয়ার প্রবেশ পথ বা করিডোর মাত্র।
সৃষ্টিজগতকে যে বিশেষ কিছু লক্ষ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে সে বিষয়ে কুরআনের অন্য আয়াতেও বক্তব্য রয়েছে। যেমন, সুরা আম্বিয়ার ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,‘আকাশ ও পৃথিবী- এ দু’য়ের মধ্যে যা আছে,তা আমি খেলার ছলে সৃষ্টি করিনি।
আমি যদি ক্রীড়া উপকরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম,তবে আমি আমার কাছে যা আছে তা দিয়েই তা করতাম,যদি আমাকে করতে হত।’
অন্য কথায় নতুন এক জগত তথা পরকালই হচ্ছে এই জগত তথা ইহকাল সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
ন্যায়বিচার ও বিবেকের নীতি এটা দাবি করে যে সৎকর্মশীল ও অসৎকর্মশীলদের পরিণতি একই ধরনের হতে পারে না। কিন্তু ইহকালীন জগতে এটা খুব কমই দেখা যায় যে এ উভয় গ্রুপ সমানুপাতিক মাত্রায় প্রতিফল পাচ্ছে। যেমন, যেই জালিম শাসক লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে এবং যে ব্যক্তি মাত্র একজন মানুষ হত্যা করেছে তাকে একই শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। তাই পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান দুনিয়ায় বা ইহকালে সম্ভব নয়। পূর্ণাঙ্গ বা যথাযথ প্রতিফল দেয়া এবং পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই দরকার পরকাল।
সুরা দুখানের ৪০ নম্বর আয়াতের পর থেকে কয়েকটি আয়াতে পুনরুত্থান তথা কিয়ামত বা বিচার দিবস এবং পাপীদের পরিণতি ও বেহেশত আর বেহেশতবাসীদের সুখময় জীবনের বিষয়ে বক্তব্য রয়েছে।
৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, নিশ্চয় ফয়সালার দিন তাদের সবারই তথা সত্য ও মিথ্যার অনুসারীদের পৃথক হওয়ার নির্ধারিত সময়।
পরের দুই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘যেদিন কোন বন্ধুই কোন বন্ধুর উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। তবে আল্লাহ যাকে দয়া করেন, তার কথা ভিন্ন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী দয়াময়।’
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সত্য ও মিথ্যাকে এবং নেককার ও পাপীদেরকে পৃথক করা হবে। সেদিন কেউ কারো সাহায্যের আহ্বানে সাড়া দিতে সক্ষম হবে না। কোনো দিক থেকেই সাহায্য পৌঁছবে না। বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনও পরস্পরের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে না। সেদিন সব চালাকি ও ফন্দি বানচাল হয়ে যাবে এবং সব পথ অচল হয়ে পড়বে, তবে আল্লাহ সেদিন যাদের সাহায্য করতে চাইবেন তাদের কথা ভিন্ন।
সুরা দুখানের ৪৩ নম্বর আয়াতের পর থেকে পরের কয়েকটি আয়াতে দোযখবাসীদের শাস্তির সামান্য এক দিক তুলে ধরা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন:
‘নিশ্চয়ই জাক্কুম গাছ পাপীর খাদ্য হবে, তা গলিত তামার মত পেটে ফুটতে থাকবে যেমন ফুটে পানি। একে ধর এবং টেনে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যস্থলে। এরপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও,স্বাদ গ্রহণ কর,তুমি তো সম্মানিত,সম্ভ্রান্ত। এ দিন সম্পর্কে তোমরা সন্দিহান ছিলে।’
ইসলামী বর্ণনায় এসেছে যদি জাহান্নামের জাক্কুম গাছের এক ফোটা চরম তিতা রস ও দ্বারি বা জারি নামের কাঁটার রস যা জাহান্নামিদের জন্য তৈরি করা চরম দুর্গন্ধযুক্ত,তিক্ত ও আগুনের মতো গরম খাদ্য- তার এক ফোটা যদি পৃথিবীর পানিতে এসে পড়ে তাহলে পৃথিবীর সবাই এর দুর্গন্ধের তীব্রতার কারণেই মারা যাবে।
জাক্কুম গাছ জাহান্নামের অধিবাসীদের অন্যতম খাবার। এ খাবার যখন তারা খাবে তখন তা তাদের পেটে গলিত ও উত্তপ্ত তামার মত ফুটতে থাকবে। ফলে তারা তাতে কোনো শক্তি না পেয়ে চরম ব্যাথা ও বেদনার শিকার হবে।
দোযখের কর্মী বা ফেরেশতাদের নির্দেশ দেয়া হবে জালিম ও গোঁড়া কাফির লোকদের ধরে দোযখের মাঝখানে নিক্ষেপ কর। এরপর বলা হবে তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দাও। অর্থাৎ ওদের শরীর ভেতর থেকেও পুড়বে এবং বাইরের দিক থেকেও পুড়বে। আগুনের উত্তাপ তাদেরকে সব দিক থেকেই দগ্ধ করবে।
অন্যদিকে সুরা দুখানে বেহেশতবাসীদের পুরস্কার, নেয়ামত ও সুখেরও কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, তারা থাকবে নিরাপদ এবং তাদের জীবন হবে সেখানে সুখময় ও বিলাসবহুল। সেখানে থাকবে উদ্যান ও নির্ঝরণী, দামী ও গর্ব করার মত পোশাক, সুশ্রী বেহেশতি স্ত্রী, নানা ধরনের সুস্বাদু ফল এবং অশেষ নেয়ামতে ভরা বেহেশত হবে মুমিনদের চিরস্থায়ী আবাস। আর এসবই মহান আল্লাহর অশেষ করুণা ও বিশ্বাসীদের জন্য মহাসাফল্য।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ১৪