নভেম্বর ২৬, ২০১৭ ১৭:৫২ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা সুরা আহকাফের ১৫ নম্বর আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম।

এই আয়াতে বাবা-মায়ের প্রতি সদাচার করার এবং তাদের যত্ন নেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মহান আল্লাহ বলেছেন:

আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থ্যে পূর্ণতায় ও চল্লিশ বছরে পৌঁছে,তখন বলতে লাগল,হে আমার পালনকর্তা,আমাকে এরূপ সৌভাগ্য দান কর যাতে আমি তোমার সেইসব নেয়ামতের শোকর করি,যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আর আমার সন্তান ও বংশধরদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমার প্রতি তওবা করলাম এবং আমি আত্মসমর্পণকারী বা আজ্ঞাবহদের অন্যতম।

 

আমরা বলেছিলাম এই আয়াতের আলোকে শিশুকে গর্ভে ধারণ করা থেকে তাকে দুধ পান করানোর সময় হচ্ছে ত্রিশ মাস। কখনও কখনও মাতৃগর্ভ থেকে ছয় মাসের শিশুও জন্ম নিয়ে থাকে। ত্রিশ মাস থেকে গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময় ৬ মাস বাদ দিলে থাকে ২৪ মাস। অর্থাৎ শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত দুধ পান করানো বৈধ। যেসব শিশু নয় মাস মার্তৃগর্ভে থেকে জন্ম নিয়েছে তাদেরকে এই আয়াতের আলোকে কমপক্ষে (৩০-৯=) ২১ মাস মায়ের দুধ পান করতে দেয়া উচিত।

 

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন,মায়েরা বাচ্চাকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। হযরত ইয়াহিয়া নবী (আ.) ছয় মাসে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁরই মত হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)ও পূর্ণ ও সুস্থভাবে ছয় মাসে জন্ম নিয়েছিলেন।

 

বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী অনেক আলেম মনে করেন যে আয়াতটি হযরত ইমাম হুসাইন (আ)’র শানে নাজিল হয়েছে। কারণ,এখানে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো ইমাম হুসাইন (আ)’র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। যেমন,৬ মাস বয়সে জন্মগ্রহণ করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে ও তাঁর বাবা-মাকে নিষ্পাপ হওয়ার সৌভাগ্য দান করা। আর এ জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। এ আয়াতের শেষের দিকে ইমাম যা বলছেন,তার যথাযথ অনুবাদ হল,‘আমার জন্য তথা আমার স্থলাভিষিক্তের জন্য আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও উপযুক্ততা তথা পুণ্যাত্মা ও ধর্মানুরাগ দান করুন।’ ইমাম হুসাইন (আ)’র এই প্রার্থনার কারণে মহান আল্লাহ তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে উপযুক্ত ব্যক্তিদের ইমাম হিসেবে মনোনীত করেছেন। হযরত ইব্রাহিম (আ)ও একই ধরনের দোয়া করেছিলেন,ফলে তাঁর বংশধরদের মধ্যে অনেকেই নবী-রাসুল হয়েছেন। বলা হয় শেষ নবী (সা) যেন তাঁরই বংশধর হয় সেই দোয়া করেছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ)। পবিত্র কুরআনে এসেছে, 

 

‘এবং যখন ইবরাহীমকে তাঁর প্রভু কয়েকটি আদেশ-বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন এবং তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মানব জাতির জন্য ইমাম ও নেতা নিযুক্ত করলাম। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও! তিনি অর্থাৎ আল্লাহ বললেন, আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।” (সূরা বাকারাহ্ : ১২৪)

অন্য কথায় যখন ইব্রাহিম (আ)  আল্লাহর রাসুল হিসেবে কয়েকটি বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তখন তাঁকে আরও বড় পদ হিসেবে মানবজাতির বিশেষ বড় নেতৃত্ব তথা ইমামত দান করা হয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় বংশানুক্রমে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল এবং তাঁর পবিত্র বংশধররাও ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ)’র উত্তরসূরি ও মানবজাতির ইমাম বা নেতা।  

 

সুরা আহকাফের ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: এরাই সেসব মানুষ আমি যাদের ভালো কাজগুলো কবুল করি এবং তাদের মন্দগুলো উপেক্ষা করি,এরাই জান্নাতের অধিবাসী হবে। এটা সেই সত্য ওয়াদা যা তাদেরকে দেয়া হত।

অর্থাৎ মহান আল্লাহ মুমিন বা বিশ্বাসী শ্রেণীর  মানুষের সবচেয়ে ভালো কাজগুলোকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের তুচ্ছ কাজগুলোকেও প্রথম শ্রেণীর কাজের তালিকায় যুক্ত করেন। আর তাঁদের গোনাহ মার্জনা করা হয় ও তাঁদের স্থান দেয়া হয় বেহেশতে। অন্যদিকে মু’মিনদের ঠিক বিপরীত অবস্থা দেখা যায় বেইমান ও সত্য বুঝতে ব্যর্থ ব্যক্তিদের মধ্যে। এরা বাবা-মায়ের অধিকারের প্রতি উদাসীন। এরা নিজ বাবা-মাকে বলে:

‘ধিক তোমাদেরকে! তোমরা কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ যে, আমি পুনরুত্থিত হব, অথচ আমার আগে বহু জনগোষ্ঠী গত হয়ে গেছে যারা কেউই জীবিত হয়নি? আর তাদের পিতা-মাতা সব সময়ই সন্তানকে সুপথে আনতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করে বলে,দুর্ভোগ তোমার! তুমি ইমান আন। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তখন সে  দম্ভভরে বলে,এটা তো পূর্ববর্তীদের রূপকথা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’


-এভাবে এই শ্রেণীর মানুষ সব সময়ই কুফরি বা মিথ্যার ওপর অবিচল থাকে গোঁড়ামি বা একগুঁয়েমির কারণে।

সুরা আহকাফের ২১ নম্বর আয়াত থেকে পরের কয়েক আয়াতে হুদ ও আদ জাতির পরিণতি সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। 

আল্লাহর অনেক নেয়ামত পাওয়ার পরও আদ জাতি মূর্তি পূজা করত। হুদ (আ) নবী হিসেবে তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলতেন। এরপর তিনি তাদের জন্য খোদায়ি শাস্তিরও ভয় দেখান। কিন্তু তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী হিসেবে তুলে ধরার জন্য খোদায়ি শাস্তি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ জানায়। আল্লাহর শাস্তি কখন আসবে তা আল্লাহই ভালো জানেন বলে হুদ নবী জবাব দেন। এই মহান নবীর নানা উপদেশ সত্ত্বেও তার জাতি অতি অল্প কয়েকজন ইমান আনে।  অবশেষে খোদায়ী শাস্তি হিসেবে এক মহাঘূর্ণি বায়ু তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়।

 

এভাবে খোদাদ্রোহী অনেক জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন যাতে অন্য যুগের খোদাদ্রোহীরাও এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়।

সুরা আহকাফের ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইসলামের মহানবী (সা)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, অতীতের নবীরাও কাফিরদের শত্রুতা ও বিরোধিতার শিকার হয়েছেন এবং তাঁদেরকে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে হয়েছে।

মহানবী (সা) ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে পাথর-বৃষ্টি ও গালি-গালাজ শোনাসহ নানা ধরনের মারাত্মক বাধার শিকার হয়েছেন এবং অনেক কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষা সয়ে ধৈর্য ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে গেছেন। ফলে ইসলাম হিজাজ ও আরব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ২৬