ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭ ১৬:২৭ Asia/Dhaka

সুরা ফাত্‌হ পবিত্র কুরআনের ৪৮ তম সুরা। মদিনায় নাজিল-হওয়া এই সুরায় রয়েছে ২৯ আয়াত।

শত্রুদের চূড়ান্তভাবে হারিয়ে দেয়ার বার্তা তথা দর্শনীয় বিজয়ের বার্তা হচ্ছে এই সুরার প্রধান আলোচ্য বিষয়। আর এ জন্যই এ সুরার নাম হয়েছে ফাত্‌হ যার অর্থ হল বিজয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধি সংক্রান্ত কিছু ঘটনা,মু’মিনদের অন্তরে প্রশান্তি আসা,মহানবী (সা)’র সঙ্গে একদল মুসলমানের বিশেষ অঙ্গীকার,বিশ্বনবীর মর্যাদা ও তাঁর উচ্চতর নানা লক্ষ্য এবং জিহাদে যাওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায় না তাদের তালিকা সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে সুরা ফাত্‌হে। এ ছাড়াও মুনাফিকদের চক্রান্তসহ তাদের নানা টালবাহানা ও অযৌক্তিক দাবি,মক্কায় প্রবেশের বিষয়ে মহানবীর (সা) স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া এবং ওমরাহ হজ পালন ও মহানবীর প্রকৃত অনুসারীদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য এই সুরার আরো কিছু আলোচ্য বিষয়।

সুরা ফাত্‌হের শানে নজুল বা এই সুরা অবতীর্ণ হওয়ার পটভূমি সম্পর্কে বলা হয়:

ষষ্ঠ হিজরিতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ওমরাহ হজ পালনের জন্য পবিত্র মক্কার দিকে রওনা হন এবং তিনি এই সফরে শরিক হতে মুসলমানদের উৎসাহ দেন। মহানবী (সা) মুসলমানদের এটা জানান,তিনি স্বপ্ন দেখেছেন যে সঙ্গীদের নিয়ে তিনি মক্কার পবিত্র মসজিদে প্রবেশ করেছেন এবং ওমরাহ হজ পালন করছেন। এ অবস্থায় একদল মুহাজির,আনসার ও বেদুইন আরব মহানবী (সা)’র সঙ্গী হয়ে মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করেন। প্রায় ১৪০০ মুসলমান মহানবীর সঙ্গী হন এই সফরে। বিশ্বনবী (সা) তাদের সবাইকে ইহরামের পোশাক পরতে বলেন। তিনি তাদেরকে কুরবানির উট সঙ্গে নিতে বলেন এবং সঙ্গে যুদ্ধের অস্ত্র-সামগ্রী না নেয়ার নির্দেশ দেন যাতে মক্কার কাফির কুরাইশরা নিশ্চিত হতে পারে যে এ সফরের উদ্দেশ্য কেবলই কাবা-ঘর জিয়ারত আর উমরাহ হজ পালন করা।

মহানবী (সা) মক্কার কাছাকাছি হুদাইবিয়ার প্রান্তরে প্রবেশ করেন। এ অবস্থায় মক্কার কুরাইশরা মহানবী (সা) ও তাঁর সাহাবিদের এই সফরের খবর পায়। কুরাইশরা এই মুসলিম কাফেলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যাতে কাফেলা নিয়ে বিশ্বনবী পবিত্র মক্কায় ঢুকতে না পারেন। 

হজগামী কাফিলা নিয়ে হুদাইবিয়া প্রান্তরে কাফিরদের বাধার মুখে বিশ্বনবী (সা) মক্কায় তাঁর প্রতিনিধি পাঠান। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রতিনিধি-বিনিময় ঘটে দুই বার। অবশেষে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর মহানবী (সা) ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল আসলে সব দিক থেকে একটি অনাক্রমণ চুক্তি।  এ চুক্তি মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যে লেগে-থাকা বা একের পর এক ঘটতে থাকা যুদ্ধগুলোর সাময়িক অবসান ঘটায়।

এ চুক্তির টেক্সট বা বক্তব্যের ভাষা নিয়ে মহানবী (সা) ও মুশরিকদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য দেখা দেয়। অবশেষে উভয়-পক্ষের সম্মতিতে চুক্তির বক্তব্যের ভাষা সংশোধন করা হয়। এ চুক্তির অন্যতম ধারা ছিল এটা যে মুহাম্মদ (সা)সহ মুসলমানরা  এ বছর মক্কায় ঢুকতে পারবে না, কিন্তু আগামী বছর তারা এই শহরে ঢুকতে পারবে। তবে শর্ত হলো এটা যে মুসলমানরা তিন দিনের বেশি এ শহরে থাকতে পারবে না এবং এই তিন দিনের মধ্যেই তাদেরকে ওমরাহ হজ সম্পন্ন করে ফিরে যেতে হবে। হুদাইবিয়ার চুক্তিতে মদিনা থেকে মক্কায় সফরকারী মুসলমানদের জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়।

এ ছাড়াও হুদাইবিয়ার চুক্তিতে দশ বছরের জন্য মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যে যুদ্ধ নিষিদ্ধ করা হয়। মক্কার মুসলমানদের ধর্ম-কর্মের স্বাধীনতা দেয়ার অনুমতিও দেয়া হয়েছিল এই চুক্তিতে।

এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বিশ্বনবী (সা) কুরবানির উটগুলোকে কুরবানি করার এবং সাহাবিদের মাথার চুল কামানোর ও ইহরাম-অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার  নির্দেশ দেন। কিন্তু একদল মুসলমানের কাছে এ নির্দেশকে তথা হজ না করেই ইহরাম থেকে বেরিয়ে আসার নির্দেশকে খুবই তিক্ত মনে হয়েছে। তাই মহানবী (সা) নিজেই এ কাজে অগ্রণী হয়ে ইহরাম থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে সাহাবারাও তা করেন। এরপর সেখান থেকেই মদিনায় ফিরে যাওয়ার পদক্ষেপ নেন। আর এ সময়ই বিশ্বনবী (সা)’র চেহারা মুবারক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি এ সময় সুরা ফাত্‌হ নাজিল হওয়ার সুসংবাদ দেন।

সুরা ফাত্‌হের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: হে নবী! নিশ্চয়ই আমরা আপনার জন্য ব্যবস্থা করেছি এক সুস্পষ্ট বিজয়ের।  

-এই আয়াতে মহান আল্লাহ যে বড় সুসংবাদ দিয়েছেন তা কোনো কোনো বর্ণনামতে তা ছিল মহানবীর (সা) কাছে গোটা বিশ্বজগতের চেয়েও বেশি প্রিয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ইসলাম এবং মুসলমানদের জীবনের অগ্রগতি সুস্পষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন বড় বিজয় ছিল খুবই কম। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর পুরো আরব উপদ্বীপে ইসলাম প্রচারের পথ সহজ হয়ে পড়ে। বিশ্বনবী (সা)’র শান্তিকামীতার বাণী প্রভাব ফেলতে থাকে নানা গোত্র বা জাতির মধ্যে। এইসব জাতি এতোদিন ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা পোষণ করতো। মুশরিকরাও এই সন্ধির ফলে অপেক্ষাকৃত সহজ পরিস্থিতির মধ্যে মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। এ সন্ধির পর নানা দল ও গোত্রের মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ফলে মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়তেই থাকে। এভাবে হুদাইবিয়ার সন্ধি ইসলামের জন্য আরও অনেক নতুন নতুন বিজয়ের পথ সুগম করেছে। তাই এ সন্ধি ছিল মুসলমানদের জন্য এক বড় বিজয়।  #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/২৩