ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭ ১৯:৩৬ Asia/Dhaka

সুরা ফাত্‌হের প্রথম আয়াতে হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা ওই আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে এই সুরা নাজিলের পটভূমি তথা হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ওই আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনার জন্যে এমন একটা ফয়সালা করে দিয়েছি,যা সুস্পষ্ট।এর পরের দুই আয়াত তথা ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘যাতে আল্লাহ আপনাকে জড়িয়ে অতীতে যত ত্রুটি বা ভুলের অভিযোগ তোলা হয়েছে ও ভবিষ্যতেও যেসব ত্রুটির অভিযোগ তোলা হবে সেসবই মার্জনা করে দেন; আর আপনার প্রতি তাঁর নেয়ামত পূর্ণ করেন ও আপনাকে সরল পথে পরিচালিত করেন এবং আপনাকে দান করেন সম্মানজনক সাহায্য।’

 

হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল এমন এক বড় বিজয় যে বিশ্বনবী (সা)’র নেতৃত্বে সূচিত এ বিজয়ের ছায়াতলে ইসলাম ও মুসলমানরা অনেক কল্যাণের অধিকারী হয়।

 এ সন্ধির ফলে শত্রুদের কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে ইসলাম এক প্রগতিশীল ও খোদায়ী ধর্ম এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত মানুষের উন্নয়ন ও সার্বিক বিকাশ ঘটায়। এ ধর্ম যে অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ ও রক্তপাতের অবসান ঘটায় সেটাও সবার কাছে স্পষ্ট হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি এটাও প্রমাণ করেছে যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন যুক্তিতে বিশ্বাসী এবং তিনি অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষা করে চলেন। শত্রুরা যদি মহানবী (সা)’র ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে না দেয় তাহলে তিনি শান্তি ও সম্প্রীতিই চান। এভাবে হুদাইবিয়ার সন্ধির সুবাদে সবার কাছেই ইসলামী শিক্ষার মহত্ত্ব ফুটে ওঠে এবং মহান আল্লাহর নেয়ামত পরিপূর্ণতা লাভ করে। হুদাইবিয়ার সন্ধির পথ ধরে আরও বড় বড় বিজয় মুসলমানদের হস্তগত হয়। যেমন, এই সন্ধির দুই বছর পর তথা অষ্টম হিজরিতে মুশরিকরা এই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করায় মুসলমানরা এর জবাব দেয়ার জন্য দশ হাজার মুজাহিদ নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হন। ফলে কোনো সংঘাত ছাড়াই মুসলমানরা মুশরিকদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি তথা মক্কা শহর দখল করে নেন। আর এই মহাবিজয়ও ছিল এই মহান সন্ধিরই সুফল।

 

রেজোয়ানের শপথ বা বাইয়াত ছিল  হুদাইবিয়ার সন্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত আরও একটি বড় ঘটনা।

আমরা আগেও শুনেছি যে হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে বিশ্বনবী (সা) ও কাফির কুরাইশ নেতাদের মধ্যে দূত-বিনিময় ঘটেছিল। মহানবী (সা) ভবিষ্যতের তৃতীয় খলিফা ওসমান বিন আফফানকে দূত হিসেবে মক্কার মুশরিকদের কাছে পাঠান যাতে তিনি তাদের এটা বোঝান যে মুসলমানরা যুদ্ধ করতে মক্কার কাছে আসেনি। কিন্তু কুরাইশরা তাকে আটক করে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে গুজব ওঠে যে ওসমান নিহত হয়েছে। এ অবস্থায় মহানবী (সা) বলেন: এই লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া আমি এখান থেকে যাব না। এরপর তিনি একটি গাছের নিচে যান এবং সাহাবিদেরকে পুনরায় অঙ্গীকারবদ্ধ করেন। তিনি তাদের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার নেন যে মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা কোনো দুর্বলতা দেখাবে না এবং যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যাবে না। আর একেই বলা হয় বাইয়াতে রেজোয়ান তথা আল্লাহর সন্তুষ্টির বাইয়াত। এই বাইয়াতের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মনোবল জোরদার করা ও তাদের আত্মত্যাগের মাত্রা পরীক্ষা করা। কুরাইশ নেতারা যখন এই ঘটনার কথা জানতে পারে তখন তারা ভয় পেয়ে রাসুলের দূত ওসমানকে ছেড়ে দেয়।

 

এ প্রসঙ্গে সুরা ফাত্‌হের ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন,যখন তারা গাছের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। এরপর তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন।’

- সুরা ফাত্‌হের ২৭ নম্বর আয়াতে মহানবীর (সা) স্বপ্ন দেখার একটি ঘটনা ও মুসলমানদের জন্য কাবা তথা মসজিদুল হারাম জিয়ারতের সুযোগ ঘটার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন:

 ‘আল্লাহ তাঁর রসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহ চাইলে তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে নিশঙ্ক চিত্তে মস্তকমুন্ডিত অবস্থায় এবং নখ বা চুল খাটো করা অবস্থায়। তোমরা কাউকে ভয় করবে না। এরপর তিনি জানেন যা তোমরা জান না। এছাড়াও তিনি দিয়েছেন তোমাদেরকে একটি আসন্ন বিজয়।’

 

-মহানবী (সা) যখন মদিনায় ফিরে আসছিলেন তখন এই আয়াতটি নাজিল হয়। এতে বলা হয়েছে যে মহানবীর (সা) স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে এবং মুসলমানরা যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়াই মক্কায় প্রবেশ করবে চূড়ান্ত নিরাপত্তাসহ। আর তারা ওমরাহ হজও পালন করবে।

হুদাইবিয়া সন্ধির ঠিক এক বছর পর বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর সাহাবিরা ওমরাহ হজ পালনের জন্য মক্কায় যান। তাঁরা ইহরাম অবস্থায় কোষবদ্ধ তরবারি নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কার কাফির নেতারা মক্কায় মুসলমানদের প্রবেশের বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে তারা এতে বাধাও দিতে পারছিল না। এ অবস্থায় তারা তাদের দৃষ্টিতে এই অপছন্দনীয় দৃশ্য তথা মুসলমানদের হজ করার দৃশ্য এড়িয়ে চলার জন্য শহরের বাইরে চলে যায়। অবশ্য মক্কার সাধারণ নারী,পুরুষ ও শিশুরা মুসলমানদের ওমরাহ হজ করার তৎপরতা দেখতে শহরেই থেকে যায়।

 

অবশেষে বিশ্বনবী (সা) মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনি মক্কাবাসীর সঙ্গে খুবই বিনম্র ও দয়ার্দ্র আচরণ করেন। মুসলমানরা যেন খুব দ্রুত কাবার চারদিকে তাওয়াফ করে সে নির্দেশ দেন আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল (সা)। হজ পালন উপলক্ষে তিন দিন মক্কায় থাকার পর মুসলমানরা এই শহর থেকে বেরিয়ে আসেন। এই ওমরাহ একদিকে ছিল যেমন ইবাদত তেমনি তা ছিল মুসলমানদের শক্তিরও প্রদর্শনী। আর এতেই মক্কা বিজয়ের বীজ বপন করা হয়েছিল। এক বছর পর মুসলমানরা মক্কা জয় করেন এবং মক্কাবাসীরা ইসলামের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

 

সুরা ফাত্‌হের শেষ আয়াতে রয়েছে মহানবীর(সা) প্রকৃত সাহাবির বৈশিষ্ট্য ও ইসলামের বিকাশ লাভের লাগসই উপমা:

মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সঙ্গীরা কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর,নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল।  আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন। তওরাতে তাদের নিদর্শনের কথা এভাবেই বলা হয়েছে এবং ইঞ্জিলে তাদের অবস্থার উপমা হল এমন যে তারা যেন একটি চারা গাছ যা থেকে বের হয় কিশলয়,এরপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কাণ্ডের ওপর এমন সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়ায় যে তা চাষিকে আনন্দে অভিভূত করে-যাতে আল্লাহ মু’মিনদের বিপুল সংখ্যা ও শক্তিমত্তা দিয়ে কাফেরদের মধ্যে ক্ষোভ বা অন্তরজ্বালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা ইমান আনে বা  বিশ্বাসী হয় এবং উপযুক্ত কাজ বা সৎকর্ম করে,আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/২৭