জানুয়ারি ০১, ২০১৮ ১৯:১০ Asia/Dhaka

সুরা মুহাম্মাদ পবিত্র কুরআনের ৪৭ তম সুরা। এই সুরার দ্বিতীয় আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

আর এরই আলোকে এ সুরার নামকরণ করা হয় মুহাম্মাদ (সা)। ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে জিহাদ এই সুরার প্রধান আলোচ্য বিষয়। পবিত্র মদিনায় নাজিল-হওয়া এই সুরায় রয়েছে ৩৮ আয়াত। 

এই সুরার কয়েকটি আলোচ্য বিষয় হল : ঈমান ও কুফর, কাফির ও মু’মিনদের অবস্থা, ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে জিহাদ করা ও যুদ্ধ-বন্দি বিষয়ক কিছু বক্তব্য। এ ছাড়াও মুনাফিকদের তৎপরতা, পৃথিবীর নানা অঞ্চলে ভ্রমণ করা ও অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়া এবং দান-খয়রাতকেও এক ধরনের জিহাদ হিসেবে গণ্য করে এই জিহাদের দিকে আহ্বান ও কাফিরদের সঙ্গে সন্ধির প্রসঙ্গ সুরা মুহাম্মাদের আরও কয়েকটি আলোচ্য বিষয়।

এই সুরার প্রথম আয়াতে কাফিরদের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন:

যারা কুফরী করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথে যোগ দিতে বাধা সৃষ্টি করে, আল্লাহ তাদের সব কাজ ব্যর্থ করে দেবেন।  

- এখানে সেইসব অবিশ্বাসী তথা কাফির ও মুশরিক দলপতিদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে। তারা কেবল নিজেরাই অবিশ্বাসী হয়ে ক্ষান্ত হয়নি, একইসঙ্গে অন্যদেরকেও নানা প্রতারণার মাধ্যমে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। তারা ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন ও মুসলমানদেরকে নির্মূল বা বিধ্বস্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু এইসব লক্ষ্যে পরিচালিত তাদের সব কাজকেই মহান আল্লাহ বানচাল করেছেন।

সুরা মুহাম্মাদের দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:        

আর যারা ঈমান আনে, সৎ কাজ করে এবং তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে মুহাম্মদের কাছে অবতীর্ণ সত্যে বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাদের মন্দ কাজগুলো মার্জনা করেন এবং তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সব বিষয় সংশোধন করে দেন।

-এ আয়াতে মু’মিন বা বিশ্বাসীদের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে মহান আল্লাহ তাদের ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর কথা প্রথমে তুলে ধরেছেন। এরপর বলছেন যে তারা মুহাম্মাদের (সা) কাছে নাজিল হওয়া সত্যে তথা মহান আল্লাহর ওহি-তে ঈমান আনে। ফলে মহানবীর (সা) তুলে ধরা সব শিক্ষা ও কর্মসূচিকেও মুমিন স্বীকৃতি দেয়। অন্য কথায় বিশ্বনবী (সা)’র কাছে যা যা নাজিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনা ছাড়া মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। এই আয়াতে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে মহানবীর (সা) কাছে যা যা নাজিল হয়েছে তা সত্য এবং তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই নাজিল হয়েছে। এভাবে মহান আল্লাহ মহানবীর(সা)  প্রচারিত ধর্মকে প্রকাশ্যে ও সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যে ধর্ম তিনি তুলে ধরেছেন মানবজাতির কাছে তাদেরই মুক্তির জন্য। আর বিশ্বাসীরাও মহানবীর (সা) এই ধর্মকে সত্য হিসেবে দেখতে পেয়ে এই ধর্ম গ্রহণ করেছেন।

সুরা মুহাম্মাদের তৃতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

এটা এ কারণে যে, যারা কাফের, তারা  মিথ্যা তথা বাতিলের অনুসরণ করে এবং যারা বিশ্বাসী, তারা তাদের পালনকর্তার কাছ থেকে আসা সত্যের অনুসরণ করে। এমনিভাবে আল্লাহ মানুষের জন্যে তাদের দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরেন।

- বিশ্বাস ও অবিশ্বাস তথা  ইমান ও কুফরির ধারা সত্য ও মিথ্যার দুই ধারা থেকে উৎসারিত। যারা মুমিন তারা সত্যের অনুসারী। আর যারা কাফির তারা মিথ্যার অনুসারী। আর এটাই হল মুমিনদের বিজয় ও কাফিরদের পরাজয়ের কারণ।

সুরা মুহাম্মাদের এই প্রথম তিন আয়াত যুদ্ধ সম্পর্কিত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সচেতন করারই ভূমিকা। আর ওই বিধান তুলে ধরে সুরা মুহাম্মাদের চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

‘এরপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও,তখন বীরত্বের সঙ্গে তাদের গর্দান মারতে থাক,অবশেষে যখন তাদেরকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত বা পরাভূত কর তখন তাদের বন্দিদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। এরপর হয় তাদের তথা এই বন্দিদের প্রতি অনুগ্রহ করে তাদের মুক্তি দাও,না হয় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নাও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করবে! বর্তমানে এটাই বিধান। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন তথা তোমাদেরকে যুদ্ধে না নামিয়েই তাদের সবাইকে ধ্বংস করতে পারতেন কিন্তু তিনি মু’মিন ও কাফিরদের যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের একদলকে আরেক দল দিয়ে পরীক্ষা করতে চান। যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়,আল্লাহ কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না।’

-আসলে যুদ্ধ হচ্ছে একটি বিশেষ পরিস্থিতি বা অবস্থা যা জুলুম ও আগ্রাসনেরই প্রতিক্রিয়া কিংবা নানা অনিষ্টতা,অবিচার ও অশান্তি দূর করার মাধ্যম। যখন মানুষ জালিম ও আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখন কঠোর আঘাত হানতে না পারলে শত্রুর হাতে পরাস্ত ও নির্মূল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সময়মতো শত্রুর ওপর কঠোর আঘাত হানা সুস্থ বিবেক ও যুক্তিরই দাবি।

এ জন্যই সুরা মুহাম্মাদের চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ শত্রুর ওপর কঠোর আঘাত হানার কথা বলেছেন এবং ইসলামের শত্রুর সারিগুলো ছিন্ন-ভিন্ন বা লণ্ডভণ্ড না হওয়া পর্যন্ত তথা তারা পুরোপুরি আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছেন মহান আল্লাহ।

যখন শত্রুরা পরাজিত ও বিধ্বস্ত হবে তখন তাদের জীবিতদেরকে বন্দি করতে বলা হয়েছে। বন্দিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য তাদেরকে শক্ত করে বেধে রাখতে বলা হয়েছে। এভাবে এখানে যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হল: শত্রুরা পুরোপুরি পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত বন্দি করার কাজ শুরু করা যাবে না। কারণ তাহলে আসল কাজ বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হতে পারে ইসলামের সেনাদল। কিন্তু শত্রুরা হেরে গেলে তখন তাদের ছেড়ে দেয়া যাবে না। কারণ তখন তাদের বন্দি করা না হলে তারা আবারও সংঘবদ্ধ হয়ে নতুন করে হামলা শুরু করতে পারে। বন্দিদের ধরে রাখার ব্যাপারে শক্ত করে বাঁধা ও তাদের ওপর কড়া নজর রাখা জরুরি।

কারণ,তারা মুজাহিদদের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে বা কারো ওপর আঘাত হানতে পারে। তবে বন্দিদের মানবীয় অধিকারগুলো সব সময়ই রক্ষা করতে হবে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর বন্দিদের হয় বিনা শর্তে মুক্ত করে দেয়া অথবা ক্ষতিপূরণ বা মুক্তিপণ হিসেবে কিছু নিয়ে তাদের মুক্তি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই আয়াতে।

এ আয়াতে যুদ্ধ পুরোপুরি নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত তথা শত্রুদের যুদ্ধ-ক্ষমতা পুরোপুরি অচল করে না দেয়া পর্যন্ত তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ও পরাজিত শত্রুদের বন্দি করার কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে যারা শহীদ হয়েছে আল্লাহ তাদের কাজকে কখনও নিষ্ফল করবেন না। আল্লাহ তাদের সব কাজকে সংশোধন করিয়ে নিয়ে তাদের চিরস্থায়ী বেহেশতে স্থান দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। অর্থাৎ তাদের অতীতের কোনো পাপ যদি থেকেও থাকে শহীদ হওয়ার কারণে সেসব ক্ষমা করার ব্যবস্থা করবেন মহান আল্লাহ। যেমন, কোনো শহীদ যদি কারো ক্ষতি করে থাকেন তার ক্ষতি আল্লাহর পক্ষ থেকে পুষিয়ে দিয়ে শহীদের প্রতি তার সন্তুষ্টি আদায় করা হবে।# 

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/০১