"জালিমদের সঙ্গে লড়াই করা সত্যিকার ঈমানের পরিচয়": সুরা মুহাম্মাদ
সুরা মুহাম্মাদের সপ্তম আয়াতে জিহাদে উৎসাহ দিয়ে মহান আল্লাহ মু’মিনদের বলছেন: ‘হে বিশ্বাসীরা! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর,আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ করবেন’।
সত্যের দুশমন ও জালিমদের সঙ্গে লড়াই করা সত্যিকারের ঈমানের অন্যতম পরিচয়। মহান আল্লাহকে সাহায্য করার অর্থ হল আল্লাহর ধর্ম এবং তাঁর নবীকে ও খোদায়ি বিধান বা শিক্ষাগুলোকে সহায়তা করা। এখানে মহান আল্লাহর যে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে তা নানা ধরনের হতে পারে। যেমন, মানুষের অন্তরকে ইমানের নূরে প্রজ্জ্বোল করা, তাদের মনোবল ও সংকল্পকে শক্তিশালী করা, নানা বিরুপ ঘটনাকে ঈমানদারদের অনুকূলে বদলে দেয়া, তাদের তৎপরতাকে ফলপ্রসূ করা। খোদায়ি নানা সাহায্যের মধ্যে পা সুদৃঢ় করার সাহায্য অন্যতম। কারণ শত্রুর মোকাবেলায় রুখে দাঁড়ানো বিজয়ের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। যুদ্ধের ময়দানে তারাই জয়ী হয় যারা বেশি প্রতিরোধ চালায় ও যাদের পা বেশি সুদৃঢ় তথা বেশি ধৈর্যশীল।
আল্লাহ মু’মিনদের সহায়তা করেন। আল্লাহর ফেরেশতারা মুমিনদের সহায়তায় ছুটে আসেন ও তাদেরকে বিপদসংকুল নানা ঘটনা বা স্থানের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু কাফিররা এইসব সুবিধার অধিকারী নয়। বেঈমান ব্যক্তির পা যখন পিছলে পড়ার উপক্রম হয় তখন কেউ তাদের ঠেকিয়ে রাখে না, এবং তারা উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়ার সময়ও কেউ তাদের রক্ষা করে না। মু’মিনদের কর্মকাণ্ড বরকতে ভরপুর। কিন্তু কাফিরদের তৎপরতা ভিত্তিহীন ও অর্থহীন এবং তাই সেসব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়।
সুরা মুহাম্মাদের আট ও নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
‘আর যারা কাফের,তাদের জন্যে আছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কাজ বিনষ্ট করে দিবেন। এটা এজন্যে যে,আল্লাহ যা নাযিল করেছেন,তারা তা পছন্দ করে না। অতএব,আল্লাহ তাদের কাজ ব্যর্থ করে দিবেন।’
সুরা মুহাম্মাদের দশ ও ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি ও এরপর দেখেনি যে,তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে? আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং কাফেরদের অবস্থা এরূপই হবে। এটা এজন্যে যে,আল্লাহ মুমিনদের হিতৈষী বন্ধু এবং কাফেরদের কোন হিতৈষী বন্ধু নেই।’
অন্য কথায় আল্লাহ কেবল মুমিনদেরকেই চূড়ান্ত সাফল্য দান করবেন ও বিভিন্ন সময়ে বিপদে আপদে তাদের সহায়তা দেবেন।
সুরা মুহাম্মাদের ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
‘অতএব,তোমরা হীনবল হয়ো না এবং শত্রুদেরকে অসম্মানজনক সন্ধির আহবান জানিও না,তোমরাই হবে প্রবল। আল্লাহই তোমাদের সাথে আছেন। তিনি কখনও তোমাদের কাজের প্রতিদান হ্রাস করবেন না।’
যাদের ঈমান দুর্বল তারা যুদ্ধের ময়দানের নানা কষ্ট ও বিপদ দেখে সন্ধির কথা বলেন। সন্ধি তখনই করা উচিত যখন তা ইসলামের উচ্চতর লক্ষ্যগুলো ও মুসলমানদের স্বার্থ আর সম্মান রক্ষা করে। কিন্তু যখন যুদ্ধে শত্রুর ওপর বিজয় ও কর্তৃত্বের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন সন্ধির প্রস্তাব তুলে বিজয়কে অসম্পূর্ণ করার কোনো অর্থ হয় না।
আসলে এ ধরনের সন্ধি হচ্ছে এমন হীনতাজনক আপোষ যার উৎস হচ্ছে দুর্বলতা ও হতাশা বা অক্ষমতার অনুভূতি।
আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে মুসলমানদের মনোবল বাড়ানোর জন্য মহান আল্লাহ বলছেন যে তিনি মুমিনদের সাথেই রয়েছেন এবং তিনি তাদের সৎ কাজগুলোর সাওয়াব বা পুরস্কার কমাবেন না। এটা খুবই স্বাভাবিক যে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ যাদের সঙ্গে রয়েছেন বিজয়ের সব কার্য-কারণ ও চলকগুলো তো তাদেরই হাতে থাকবে এবং তাদের মধ্যে কখনও দুর্বলতা ও অক্ষমতা দেখা যাবে না।
আলোচ্য আয়াতের সঙ্গে সুরা আনফালের ৬১ নম্বর আয়াতের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এই আয়াতে বলা হয়েছে:
আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে,তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রবণকারী;পরিজ্ঞাত।
-এ দুই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে পরিস্থিতিই বলে দেবে যে কখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে ও কখন সন্ধি করতে হবে। সন্ধি দুই ধরনের: সম্মানজনক এবং অযৌক্তিক বা অসম্মানজনক সন্ধি। মুসলমানদের জন্য সম্মানজনক সন্ধি তাদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষা করে। অসম্মানজনক সন্ধিতে মুসলমানদের স্বার্থ ও মান-সম্মান কোনোটাই থাকে না। বিজয় যখন প্রায় হাতের নাগালে তখনই হতাশ ও দুর্বলমনা লোকেরা এ ধরনের সন্ধির প্রস্তাব দেয়।
সুরা মুহাম্মাদের সর্বশেষ আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় দান করার গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। মহান আল্লাহ বলছেন:
‘জেনে রাখ,তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহবান জানানো হচ্ছে, অতঃপর তোমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছে। যারা কৃপণতা করছে, তারা নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করছে। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা সবাই অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও,তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন,এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।’
-দানের রয়েছে অজস্র কল্যাণ। দান ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনে এবং সমাজে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। দান শত্রুতা ও প্রতিহিংসাকে দূর করে ও হৃদ্যতা আর আন্তরিকতাকে বাড়িয়ে দেয়। দানবীর পরকালেও অনেক প্রতিদানের অধিকারী হয়। তাই কেউ যদি কার্পণ্য করে তাহলে সে যেন নিজের সঙ্গেই কার্পণ্য করলো। আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: তিনি অশেষ সম্পদের অধিকারী ও তোমাদের দানের মুখাপেক্ষী নন। বরং তোমরাই ইহকাল ও পরকালে মহান আল্লাহর দয়া আর করুণার মুখাপেক্ষী। আল্লাহ ছাড়া অন্য সবই নানা ধরনের চাহিদার মুখাপেক্ষী;কিন্তু একমাত্র মহান আল্লাহই সত্তাগতভাবে অভাবমুক্ত।
আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে মুসলমানদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হচ্ছে,তাদের উচিত আল্লাহর সব নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। বিশেষ করে এ জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া যে তিনি মুসলমানদেরকে তার ধর্মের সংরক্ষক করেছেন যাতে তারা এই ধর্মের সাহায্যকারী ও মহানবীর (সা) সহযোগী হয়। মুসলমান হওয়ার দাবিদাররা যদি এই দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী না হয় তাহলে তিনি অন্য কোনো গোষ্ঠীর ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করবেন এবং তারা এই নামধারী বা দুর্বল মুসলমানদের মত ধর্ম-বিমুখ হবেন না। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/১৯