সুরা জারিয়াতের প্রাথমিক পরিচিতি ও ব্যাখ্যা
সুরা জারিয়াত পবিত্র কুরআনের ৫১ তম সুরা। মক্কায় নাজিল-হওয়া এ সুরায় রয়েছে ৬০ আয়াত। জারিয়াত শব্দের অর্থ হল এমন বাতাস যা মেঘমালাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয় ও মেঘমালায় গতি-সঞ্চার করে।
এই সুরায় পরকাল ও পুনরুত্থান, কাফেরদের প্রতি তিরস্কার, খোদাভীরুদের পুরস্কার, সৃষ্টির মধ্যে একত্ববাদের নানা নিদর্শন এবং হযরত ইব্রাহিম (আ)'র মেহমান ও লুত জাতির পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। মুসা নবীর (আ) কাহিনী, আদ, সামুদ ও নুহ (আ) নবীর জাতির কাহিনী এবং অতীতের নবীদের বিরুদ্ধে অবাধ্য জাতিগুলোর সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও রয়েছে সুরা জারিয়াতে। এছাড়াও এই সুরায় বিশ্বনবী (সা)'র নানা নসিহত এবং সৃষ্টির দর্শন বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে ।
সুরা জারিয়াতের প্রথম ৬ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'কসম ঝঞ্ঝাবায়ুর যা ছড়িয়ে পড়ে তথা যা বৃষ্টিদায়ক মেঘ ও উদ্ভিদের বীজকে বয়ে বেড়ায় বা সঞ্চালন করে। অতঃপর বৃষ্টির বোঝা-বহনকারী মেঘের শপথ। অতঃপর শপথ সেইসব কিশতির যা সাগরগুলোতে চলে সহজেই মৃদু গতিতে, অতঃপর শপথ কর্ম-বন্টনকারী ফেরেশতাগণের, তোমাদেরকে দেয়া ওয়াদা অবশ্যই সত্য এবং বিচারের দিন অবশ্যম্ভাবী।'
সুরা জারিয়াত শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি শপথের মধ্য দিয়ে। এইসব শপথের রয়েছে গভীর অর্থ ও তাৎপর্য। পাঠককে সচেতন করা ও চিন্তাভাবনার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া এইসব শপথের অন্যতম লক্ষ্য। এইসব শপথ বিশ্ব-জগতে মহান আল্লাহর সার্বজনীন ব্যবস্থাপনার মাহাত্ম্য তুলে ধরছে। এই শপথগুলোর ভাবার্থ পরকালের বিষয়কে অনেক গভীর ও চমৎকারভাবে তুলে ধরে।
এ জাতীয় শপথগুলো পবিত্র কুরআনের অন্যতম বড় মু’জিজা বা অলৌকিকতা ও অনন্য সৌন্দর্যে ভাস্বর। মহান আল্লাহর অতুল মাহাত্ম্য ও ক্ষমতার দিকে বান্দাহর দৃষ্টি আকর্ষণও এ ধরনের শপথের অন্যতম লক্ষ্য। শপথের শব্দ বা বাক্যের সঙ্গে পরের বক্তব্য বা উপসংহারের মিল ও সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, মেঘের গতিশীলতা বা সঞ্চালন ও বৃষ্টি বর্ষণের ফলে মৃত ভূমির সজীব হয়ে ওঠার দৃষ্টান্তের সঙ্গে মৃত মানুষের পুনরুত্থানের ঘটনার মিল রয়েছে। অর্থাৎ মেঘমালা ও বৃষ্টি এবং মৃত ভূমির জেগে ওঠার বিষয়টি এ দুনিয়াতেই পুনরুত্থানের বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। তাই পবিত্র কুরআনে অনেক বার এই উপমাটি তুলে ধরা হয়েছে।
শপথের মাধ্যমে এটা বুঝিয়ে দেয়া হয় যে এরপর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আসছে। সুরা জারিয়াতে এইসব শপথের পর মহান আল্লাহ বলছেন, তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই সত্য। এখানে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবেই বলতে কিয়ামত বা বিচার দিবসের হিসাব-কিতাব এবং শাস্তি ও পুরস্কার তথা বেহেশত ও দোযখের কথা বলা হচ্ছে।
সুরা জারিয়াতের ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'বিশ্বাসীদের জন্যে পৃথিবীতে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বের নিদর্শনাবলী রয়েছে।'
সুরা জারিয়াতের ২০ নম্বর আয়াতের পর থেকে মহান আল্লাহর নিদর্শন প্রসঙ্গে বক্তব্য রয়েছে। স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে জমিনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা নানা নিদর্শন ছাড়াও মানব-দেহের মধ্যেই রয়েছে মহান আল্লাহর অনেক নিদর্শন। মহান আল্লাহর অশেষ জ্ঞান ও ক্ষমতার বহু নিদর্শন ছড়িয়ে আছে জমিন বা ভূমণ্ডলে।
পৃথিবীর বিশাল আয়তন ও পরিধি, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব, নিজের ও সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তন, আকর্ষণ ও বিকর্ষণের শক্তি এবং এর ফলে নানা বিষয়ের উন্মেষ- এসবই পরস্পরের সঙ্গে সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ। জীবনের পরিবেশ সৃষ্টিকারী এ বিষয়গুলো এতো পরিপূর্ণ নিখুঁত ও এতো বেশি হিকমাতপূর্ণ বা প্রজ্ঞাজনোচিত যে বিস্ময়ে খেই হারিয়ে ফেলেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরা। মহাজাগতিক এসব বিষয়ের গতি ও পরস্পরের দূরত্বে যদি সামান্য বা বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটে তাহলে পৃথিবী হয়ে পড়বে বসবাসের অযোগ্য। নিঃসন্দেহে এসবই মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার কিছু নিদর্শন।
ভূমির উপাদানগুলোও এক মহাবিস্ময়। ভূমিতে যেসব সম্পদ গচ্ছিত আছে খনিজ আকারে বা সম্পদের গুদামের আকারে সেসব ছাড়া জীব-জগত টিকে থাকতে পারত না। এসবই মহান আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সাক্ষ্য বহন করছে। পাহাড়, সমতল প্রান্তর, গভীর জঙ্গল, সাগর-মহাসাগর ও নদ-নদী, ঝর্ণা, খালবিল-এসবই জীব-জগতকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। অদ্ভুত ও বিচিত্র বৈশিষ্টের হাজার হাজার প্রজাতির গাছপালা, কীট-পতঙ্গ ও পশু-পাখি-এসবই মহান আল্লাহর অশেষ সৃষ্টি-নৈপুন্যের নিদর্শন।
সুরা জারিয়াতের ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, 'তোমরা তথা মানুষের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর নিদর্শন, তোমরা কি তা জানো না?'
-মহাবিস্ময়ের ব্যাপার হল এতো সৃষ্টিশীল, প্রতিভাবান ও বুদ্ধিমান মানুষের জন্ম হয় তুচ্ছ বীর্য থেকে। আর এই বীর্য বা শুক্র যখন মাতৃগর্ভে স্থান পায় তখন তা দ্রুত বেড়ে-ওঠা জীবন্ত সত্তা হিসেবে গড়ে ওঠে এবং অল্প সময়েই পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়।
মানব-দেহের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হল মানব-কোষ। এই কোষের গঠন এতোই বিচিত্র ও বিস্ময়কর যে বিজ্ঞানীদের মতে তা একটি শিল্প-শহরের মতোই নানা স্থাপনায় পরিপূর্ণ।
একজন জীব-বিজ্ঞানী বলেছেন, মানব-কোষ হচ্ছে এমন এক বিস্ময়কর বিশাল শহরের মত যাতে রয়েছে হাজার হাজার কারখানা, পাইপ-লাইনের নেটওয়ার্ক, কমান্ড-সেন্টার, বিপুল স্থাপনা ও জৈবিক নানা তৎপরতা। আর আমাদের হাতে এইসব তৎপরতা চালানোর উপযুক্ত স্থাপনাগুলো তৈরি করতে হলে দরকার হত অনেক প্রশস্ত জমি, ভবন ও জটিল কাজের বিপুল যন্ত্রপাতি আর সাজ-সরঞ্জাম। কিন্তু মহান আল্লাহ এই সবই অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্থানে জড়ো করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের শরীরের নানা অঙ্গ যেমন, হৃদপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস-এসবের সঙ্গে রয়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ছোট-বড় ও সূক্ষ্ম নানা ধরনের রগ। এতো সূক্ষ্ম রগও রয়েছে যে সেসবকে খালি চোখে দেখা যায় না। আর এইসব রগ হাজার হাজার কোটি মানব-কোষের খাবার বা রসদ যোগায়। তদ্রুপ মানুষের চোখ বা দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণ-শক্তি ও নানা অনুভূতিসহ পঞ্চেন্দ্রিয়- এসবই মহান প্রতিপালকের কিছু নিদর্শন। সবচেয়ে বড় কথা হল মানুষের জীবন তথা প্রাণের রহস্য কিংবা বস্তুগত স্বরূপ এবং রুহ বা আত্মার স্বরূপ আজও সব মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। কোন্ শক্তি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মানুষের মৃত্যু ঘটে তা বিজ্ঞানীরা আজও উদঘাটন করতে পারেননি। তাই মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার কাছে মানুষের নতি স্বীকার করা উচিত এবং এইসব ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের অজান্তেই মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/১০