মার্চ ১৩, ২০১৮ ১৯:৩৬ Asia/Dhaka

পরিবার ও সমাজে বিদ্যমান সম্পর্কের ধরণকেই পুরোপুরি পাল্টে দিচ্ছে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগত।

সমাজবিজ্ঞানীরা বারবারই বলছেন, সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজে বিদ্যমান সুস্থ সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে এবং এ বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা অনুসরণ করতে হবে। আজকের আসরেও আমরা পরিবারে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রভাব নিয়ে কথা বলব।

বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশের রাজনীতি,অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমেরিকার বিখ্যাত লেখক এলভিন টফলার মানব সভ্যতাকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো,কৃষি ভিত্তিক সভ্যতা, শিল্প ভিত্তিক সভ্যতা এবং তথ্য ও কম্পিউটার নির্ভর সভ্যতা। বর্তমানে আমরা এলভিন টফলারের তথ্যনির্ভর সভ্যতায় বাস করছি। তার মতে, তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকবে তারাই ক্ষমতার অধিকারী হবে। এর আগের আসরগুলোতেও যেমনটি বলেছি, কম্পিউটার ভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যমের যে ক্ষেত্রটি পরিবার ব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে তাহলো সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম। এ ক্ষেত্রে ফেইসবুকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম তথা ইন্টারনেটের প্রভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনা কমে গেছে। বর্তমানে পরিবারের সদস্যরা দৈনিক গড়ে ১৫ মিনিটও নিজেদের মধ্যে কথা বলে না। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এখন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তার গণ্ডিকেও লঙ্ঘন করছে। এর ফলে ঝগড়া-বিবাদ ও তালাকের মতো তিক্ত ঘটনা ঘটছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর যে বন্ধুমহল তৈরি হচ্ছে তা নানা সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে এবং পরস্পরের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস নষ্ট করছে। মুসলিম দেশগুলোতে পারিবারিক ব্যবস্থার সঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে পরিবারগুলোতে এখনও ধর্মীয় আবহ বিদ্যমান। কিন্তু ইন্টারনেটে ইসলাম বিরোধী দেশ ও মহলের আধিপত্য থাকায় এসব মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে।

পরিস্থিতি ক্রমেই এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে, ইসলামি জীবনপদ্ধতিতে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে এবং নতুন প্রজন্মকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে। মুসলিম সমাজে ধর্ম ও ধর্মীয় পরিচিতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচিতির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রভাবে তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। বর্তমানে ইন্টারনেট নতুন নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টির চেয়ে মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচিতিতে পরিবর্তন সাধন করছে বেশি। তরুণ সমাজের মধ্যে আত্মপরিচয় সংকট তীব্রতর হচ্ছে। অবশ্য ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগত ব্যবহার করলেই একজন মানুষ আত্মপরিচয় বা ধর্মীয় সংকটে পড়বে এমন কথা বলা যাবে না। এ সংকট তখনি সৃষ্টি হয় যখন একজন ব্যবহারকারী ধোঁকায় পড়ে এবং প্রতারণার শিকার হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি যতবেশি এ ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করবে ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য শক্তি গোটা বিশ্বে প্রভাব ও আধিপত্য বাড়ানোর জন্য নিজের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট তাদের জন্য এক বড় সুযোগ হিসেবে কাজ করছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাদের সংস্কৃতিকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের সহযোগিতায় তাদের এ অশুভ তৎপরতা এরইমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রতিটি স্তরেই এমন এক সংস্কৃতি প্রবেশ করানো হচ্ছে যার সঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং অতীত অভিজ্ঞতার কোনো সম্পর্ক নেই। মুসলিম সমাজে এমন সব বিষয় চালুর চেষ্টা চলছে যেগুলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। শুধু মুসলিম চিন্তাবিদরা নন, বহু অমুসলিম চিন্তাবিদও পাশ্চাত্যের ছড়িয়ে দেওয়া সংস্কৃতিকে মানব সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক বলে মনে করেন। এটাকে পুঁজিবাদ রক্ষার সংস্কৃতি বলে মনে করা হয়।         

ভার্চুয়াল জগতের প্রভাবে ব্যক্তির আত্মপরিচয় পরিবর্তনের বিষয়টিও লক্ষণীয়। আত্মপরিচয়ের তিনটি উপাদান রয়েছে। এগুলো হলো, ব্যক্তিগত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। তিনটি উপাদানই ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্টারনেটে একজন ব্যক্তি বিভিন্ন সময় ও পর্যায়ে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিক থেকে নানা অবস্থা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। কখনো কখনো এমন সব জীবন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় লাভ করে যা তার চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতিতেও এর একটা প্রভাব পড়ে। শুধু তাই নয় অনেকেই আছেন যারা ইন্টারনেটে নিজের পরিচয় গোপন করে তৎপরতা চালায়। অনেক ছেলে নিজেকে মেয়ে হিসেবে আবার অনেক মেয়ে নিজেকে ছেলে হিসেবে তুলে ধরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং অপর পক্ষকে প্রতারিত করে। এছাড়া এমনও দেখা যাচ্ছে, বেশি বয়সী মানুষ নিজেকে অল্প বয়সী হিসেবে তুলে ধরে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে এবং শিশু-কিশোরদেরকে এমন সব বিষয় শেখাচ্ছে যা কোনোভাবেই ওই বয়সে শেখা উচিত নয়। এ কারণে একটু অসতর্ক হলেই ভার্চুয়াল জগত ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। #      

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/১৩

ট্যাগ